PK

চাঁদের পাহাড়/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

চার
 ষ্টেশনে বড়ই জলের কষ্ট। ট্রেণ থেকে যা জল দেয়, তাতে রান্না-খাওয়া কোনোরকমে চলে— স্নান আর হয় না । এখানকার কুয়োর জলও শুকিয়ে গিয়েচে । একদিন সে শুনলে ষ্টেশনে থেকে মাইল তিনেক দূরে একটা জলাশয় আছে, সেখানে ভালো জল পাওয়া যায়, মাছও আছে ।
 স্নান ও মাছ ধরবার আকর্ষণে একদিন সে সকালের ট্রেণ রওনা করে দিয়ে সেখানে মাছ ধরতে চলল— সঙ্গে একজন সোমালি কুলী, সে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। মাছ ধরার সাজসরঞ্জাম
মোম্বাসা থেকে আনিয়ে নিয়েছিল । জলাশয়টা মাঝারি গোছের, চারি ধারে উঁচু ঘাসের বন, ইউকা গাছ, কাছেই একটা অনুচ্চ পাহাড় । জলে সে স্নান সেরে উঠে ঘণ্টা দুই ছিপ ফেলে ট্যাংরা জাতীয় ছোট ছোট মাছ অনেকগুলি পেলে । মাছ অদৃষ্টে জোটেনি অনেকদিন কিন্তু বেশী দেরী করা চলবে না— কারণ আবার বিকেল চারটের মধ্যে ষ্টেশনে পৌঁছুনো চাই, বিকেলের ট্রেণ পাশ করাবার জন্যে ।
 এখন প্রায়ই সে মাঝে মাঝে মাছ ধরতে যায় । কোনোদিন সঙ্গে লোক থাকে— প্রায়ই একা যায়। স্নানের কষ্টও ঘুচেছে ।
 গ্রীষ্মকাল ক্রমেই প্রখর হয়ে উঠল । আফ্রিকার দারুণ গ্রীষ্ম— বেলা ন’টার পর থেকে আর রোদে যাওয়া যায় না । এগারোটার পর থেকে শঙ্করের মনে হয় যেন দিকবিদিক দাউদাউ করে জ্বলচে । তবুও সে ট্রেণের লোকের মুখে শুনলে মধ্য-আফ্রিকা ও দক্ষিণ-আফ্রিকার গরমের কাছে এ নাকি কিছুই নয় !
 শীঘ্রই এমন একটা ঘটনা ঘটল যা থেকে শঙ্করের জীবনের গতি মোড় ঘুরে অন্য পথে চলে গেল । একদিন সকালের দিকে শঙ্কর মাছ ধরতে গিয়েছিল । যখন ফিরচে তখন বেলা তিনটে । ষ্টেশন যখন আর মাইলটাক আছে, তখন শঙ্করের কাণে গেল সেই রৌদ্রদগ্ধ প্রান্তরের মধ্যে কে যেন কোথায় অস্ফুট আর্ত্তস্বরে কি বলচে । কোনদিক থেকে স্বরটা আসচে, লক্ষ্য করে কিছুদূর যেতেই দেখলে একটা ইউকা গাছের নিচে স্বল্পমাত্র ছায়াটুকুতে কে একজন বসে আছে ।
 শঙ্কর দ্রুতপদে তার নিকটে গেল । লোকটা ইউরোপীয়ান— পরণে তালি দেওয়া ছিন্ন ও মলিন কোটপ্যান্ট । একমুখ লাল দাড়ি, বড় বড় চোখ, মুখের গড়ন বেশ সুশ্রী, দেহও বেশ বলিষ্ঠ ছিল বোঝা যায়, কিন্তু সম্ভবতঃ রোগে, কষ্টে ও অনাহারে বর্ত্তমানে শীর্ণ । লোকটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে অবসন্ন ভাবে পড়ে আছে । তার মাথায় মলিন সোলার টুপিটা একদিকে গড়িয়ে পড়েচে মাথা থেকে— পাশে একটা খাকি কাপড়ের বড় ঝোলা ।
 শঙ্কর ইংরিজিতে জিজ্ঞেস করলে— তুমি কোথা থেকে আসচো?  লোকটা কথার উত্তর না দিয়ে মুখের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে জলপানের ভঙ্গি করে বল্লে— একটু জল ! জল !
 শঙ্কর বল্লে— এখানে তো জল নেই । আমার উপর ভর দিয়ে ষ্টেশন পর্য্যন্ত আসতে পারবে ?
 অতি কষ্টে খানিকটা ভর দিয়ে এবং শেষের দিকে একরকম শঙ্করের কাঁধে চেপে লোকটা প্ল্যাটফর্ম্মে পৌঁছুলো । ওকে আনতে গিয়ে দেরী হয়ে গেল, বিকেলের ট্রেণ ওর অনুপস্থিতিতেই চলে গিয়েচে । ও লোকটাকে ষ্টেশনঘরে বিছানা পেতে শোয়ালে, জল খাইয়ে সুস্থ করলে, কিছু খাদ্যও এনে দিলে । সে খানিকটা চাঙ্গা হয়ে উঠল বটে, কিন্তু শঙ্কর দেখলে লোকটার ভারি জ্বর হয়েচে । অনেক দিনের অনিয়মে, পরিশ্রমে, অনাহারে তার শরীর একেবারে ভেঙে গিয়েচে— দু-চারদিনে সে সুস্থ হবে না ।
 লোকটা একটু পরে পরিচয় দিলে । তার নাম ডিয়েগো আলভারেজ— জাতে পর্টুগিজ, তবে আফ্রিকার সূর্য্য তার বর্ণ তামাটে করে দিয়েচে ।
 রাত্রে ওকে ষ্টেশনে রাখলে শঙ্কর । কিন্তু ওর অসুখ দেখে সে পড়ে গেল বিপদে— এখানে ওষুধ নেই, ডাক্তার নেই— সকালের ট্রেণ মোম্বাসার দিকে যায় না, বিকেলের ট্রেণে গার্ড রোগীকে তুলে নিয়ে যেতে পারে । কিন্তু রাত কাটতে এখনো অনেক দেরী । বিকেলের গাড়ীখানা ষ্টেশনে এসে যদি পাওয়া যেত, তবে তো কোনো কথাই ছিল না ।  শঙ্কর রোগীর পাশে রাত জেগে বসে রইল । লোকটীর শরীরে কিছু নেই । খুব সম্ভবতঃ কষ্ট ও অনাহার ওর অসুখের কারণ । এই দূর বিদেশে, ওর কেউ নেই— শঙ্কর না দেখলে ওকে দেখবে কে ? বাল্যকাল থেকেই পরের দুঃখ সহ্য করতে পারে না সে, শঙ্কর যেভাবে সারা রাত তার সেবা করলে, তার কোনো আপনার লোক ওর চেয়ে বেশী কিছু করতে পারতো না ।
 উত্তর-পূর্ব্ব কোণের অনুচ্চ পাহাড়শ্রেণীর পেছন থেকে চাঁদ উঠচে যখন সে রাত্রে— ঝমঝম করছে নিস্তব্ধ নিশীথ রাত্রি— তখন হঠাৎ প্রান্তরের মধ্যে ভীষণ সিংহ-গর্জ্জন শোনা গেল, রোগী তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিল— সিংহের ডাকে সে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল । শঙ্কর বল্লে— ভয় নেই, শুয়ে থাকো । বাইরে সিংহ ডাকচে, দরজা বন্ধ আছে ।
 তারপর শঙ্কর আস্তে আস্তে দরজা খুলে প্ল্যাটফর্ম্মে এসে দাঁড়ালো । দাঁড়িয়ে চারিধারে চেয়ে দেখবামাত্রই যেন সে রাত্রির অপূর্ব্ব দৃশ্য তাকে মুগ্ধ করে ফেললে । চাঁদ উঠেচে দূরের আকাশপ্রান্তে— ইউকা গাছের লম্বা লম্বা ছায়া পড়েচে পুব থেকে পশ্চিমে, ঘাসের বন যেন রহস্যময়, নিস্পন্দ । সিংহ ডাকচে ষ্টেশনের কোয়ার্টারের পিছনে প্রায় পাঁচশো গজের মধ্যে । কিন্তু সিংহের ডাক আজকাল শঙ্করের গা-সওয়া হয়ে উঠেচে— ওতে আর আগের মতো ভয় পায় না । রাত্রির সৌন্দর্য্য এত আকৃষ্ট করেছে ওকে যে ও সিংহের সান্নিধ্য যেন ভুলে গেল ।  ফিরে ও ষ্টেশনঘরে ঢুকল । টং টং করে ঘড়িতে দুটো বেজে গেল । ও ঘরে ঢুকে দেখলে রোগী বিছানায় উঠে বসে আছে । বল্লে— একটু জল দাও, খাব ।
 লোকটা বেশ ভালো ইংরিজি বলতে পারে । শঙ্কর টিন থেকে জল নিয়ে ওকে খাওয়ালে ।
 লোকটার জ্বর তখন যেন কমেচে । সে বল্লে— তুমি কি বলছিলে? আমার ভয় করছে ভাবছিলে? ডিয়েগো আলভারেজ, ভয় করবে? ইয়্যাংম্যান, তুমি ডিয়েগো আলভারেজকে জানো না । লোকটার ওষ্ঠপ্রান্তে একটা হতাশা, বিষাদ ও ব্যঙ্গ মিশানো অদ্ভুত ধরনের হাসি দেখা দিলে । সে অবসন্ন ভাবে বালিশের গায়ে ঢলে পড়ল । ওই হাসিতে শঙ্করের মনে হোল এ লোক সাধারণ লোক নয় । তখন ওর হাতের দিকে নজর পড়ল শঙ্করের । বেঁটে বেঁটে, মোটা মোটা আঙ্গুল— দড়ির মতো শিরাবহুল হাত, তাম্রাভ দাড়ির নিচে চিবুকের ভাব শক্ত মানুষের পরিচয় দিচ্চে । এতক্ষণ পরে খানিকটা জ্বর কমে যাওয়াতে আসল মানুষটা বেরিয়ে আসচে যেন ধীরে ধীরে।
 লোকটা বল্লে— সরে এসো কাছে । তুমি আমার যথেষ্ট উপকার করেচ । আমার নিজের ছেলে থাকলে এর বেশি করতে পারতো না । তবে একটা কথা বলি— আমি বাঁচবো না । আমার মন বলছে আমার দিন ফুরিয়ে এসেচে । তোমার উপকার করে যেতে চাই । তুমি ইন্ডিয়ান? এখানে কত মাইনে পাও? এই সামান্য মাইনের জন্যে দেশ ছেড়ে এত দূর এসে আছ যখন, তখন তোমার সাহস আছে, কষ্ট সহ্য করবার শক্তি আছে । আমার কথা মন দিয়ে শোনো, কিন্তু প্রতিজ্ঞা করো আজ তোমাকে যেসব কথা বলবো— আমার মৃত্যুর পূর্ব্বে তুমি কারো কাছে তা প্রকাশ করবে না?
 শঙ্কর সেই আশ্বাসই দিলে । তারপর সেই অদ্ভুত রাত্রি ক্রমশঃ কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে এমন এক আশ্চর্য্য, অবিশ্বাস্য ধরনের আশ্চর্য্য কাহিনী শুনে গেল— যা সাধারণতঃ উপন্যাসেই পড়া যায় ।

ডিয়েগো আলভারেজের কথা
 ইয়্যাংম্যান, তোমার বয়স কত হবে? বাইশ? …তুমি, যখন মায়ের কোলে শিশু— আজ বিশ বছর আগের কথা, ১৮৮৮-৮৯ সালের দিকে আমি কেপ কলোনির উত্তরে পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যে সোনার খনির সন্ধান করে বেড়াচ্ছিলাম । তখন বয়েস ছিল কম, দুনিয়ার কোনো বিপদকেই বিপদ বলে গ্রাহ্য করতাম না ।
 বুলাওয়েও শহর থেকে জিনিসপত্র কিনে একাই রওনা হলাম, সঙ্গে কেবল দু’টী গাধা, জিনিসপত্র বইবার জন্যে । জাম্বেসি নদী পার হয়ে চলেচি, পথ ও দেশ সম্পূর্ণ অজ্ঞাত, শুধু ছোটখাটো পাহাড়, ঘাস, মাঝে মাঝে কাফিরদের বস্তি । ক্রমে যেন মানুষের বাস কমে এল, এমন এক জায়গায় উপস্থিত এসে পৌঁছনো গেল, যেখানে এর আগে কখনো কোনো ইউরোপীয়ান আসেনি।
যেখানেই নদী বা খাল দেখি— কিংবা পাহাড় দেখি— সকলের আগে সোনার স্তরের সন্ধান করি । লোকে কত কি পেয়ে বড়মানুষ হয়ে গিয়েচে দক্ষিণ-আফ্রিকায়, এ সম্বন্ধে বাল্যকাল থেকে কত কাহিনীই শুনে এসেছিলুম— সেই সব গল্পের মোহই আমায় আফ্রিকায় নিয়ে এসে ফেলেছিল । কিন্তু বৃথাই দু’বৎসর নানাস্থানে ঘুরে বেড়ালুম । কত অসহ্য কষ্ট সহ্য করলুম এই দু’বছরে । একবার তো সন্ধান পেয়েও হারালুম ।
সেদিন একটা হরিণ শিকার করেছি সকালের দিকে । তাঁবু খাটিয়ে মাংস রান্না করে শুয়ে পড়লুম দুপুরবেলা— কারণ দুপুরের রোদে পথ চলা সেসব জায়গায় একরকম অসম্ভব— ১১৫ ডিগ্রী থেকে ১৩০ ডিগ্রী পর্যন্ত উত্তাপ হয় গ্রীষ্মকালে । বিশ্রামের পরে বন্দুক পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখি বন্দুকের নলের মাছিটা কোথায় হারিয়ে গিয়েচে । মাছি না থাকলে রাইফেলের তাগ ঠিক হয় না । কত এদিক ওদিক খুঁজেও মাছিটা পাওয়া গেল না । কাছেই একটা পাথরের ঢিবি, তার গায়ে সাদা সাদা কি একটা কঠিন পদার্থ চোখে পড়ল । ঢিবিটার গায়ে সেই জিনিসটা নানা স্থানে আছে। বেছে বেছে তারই একটি দানা সংগ্রহ করে ঘষে মেজে নিয়ে আপাততঃ সেটাকেই মাছি করে রাইফেলের নলের আগায় বসিয়ে নিলাম। তারপর বিকেলে সেখান থেকে আবার উত্তর মুখে রওনা হয়েছি, কোথায় তাঁবু ফেলেছিলাম, সে কথা ক্রমেই ভুলে গিয়েছি ।
দিন পনেরো পরে একজন ইংরেজের সঙ্গে সাক্ষাৎ হোল, সেও আমার মত সোনা খুঁজে বেড়াচ্চে । তার সঙ্গে দু’জন মাটাবেল কুলী ছিল । পরস্পরকে পেয়ে আমরা খুশি হলাম, তার নাম জিম কার্টার, আমারই মতো ভবঘুরে, তবে তার বয়েস আমার চেয়ে বেশি । জিম একদিন আমার বন্দুকটা নিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে হঠাৎ কি দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল । আমায় বল্লে— বন্দুকের মাছি তোমার এরকম কেন? তারপর আমার গল্প শুনে সে উত্তেজিত হয়ে উঠল। বল্লে— তুমি বুঝতে পারোনি এ জিনিসটা খাঁটী রুপো, খনিজ রুপো । এ যেখানে পাওয়া যায় সাধারণতঃ সেখানে রুপোর খনি থাকে । আমার আন্দাজ হচ্ছে এক টন পাথর থেকে সেখানে অন্ততঃ ন’হাজার আউন্স রুপো পাওয়া যাবে । সে জায়গাতে এক্ষুণি চলো আমরা যাই । এবার আমরা লক্ষপতি হয়ে যাবো ।
সংক্ষেপে বলি । তারপর কার্টারকে সঙ্গে নিয়ে আমি যে পথে এসেছিলাম, সেই পথে আবার এলাম । কিন্তু চার মাস ধরে কত চেষ্টা করে, কত অসহ্য কষ্ট পেয়ে, কতবার বিরাট দিকদিশাহীন মরুভূমিবত্‍ ভেল্ডের মধ্যে পথ হারিয়ে, মৃত্যুর দ্বার পর্য্যন্ত পৌঁছেও, কিছুতেই আমি সে স্থান নির্ণয় করতে পারলাম না। যখন সেখান থেকে সেবার তাঁবু উঠিয়ে দিয়েছিলাম, অত লক্ষ্য করিনি জায়গাটা । আফ্রিকার ভেল্ডে কোনো চিহ্ন বড় একটা থাকে না, যার সাহায্যে পুরোণো জায়গা খুঁজে বার করা যায়— সবই যেন একরকম । অনেকবার হয়রাণ হয়ে শেষে আমরা রুপোর খনির আশা ত্যাগ করে গুয়াই নদীর দিকে চললাম । জিম কার্টার আমাকে আর ছাড়লে না । তার মৃত্যু পর্য্যন্ত আমার সঙ্গেই ছিল । তার সে শোচনীয় মৃত্যুর কথা ভাবলে এখনও আমার কষ্ট হয় ।
তৃষ্ণার কষ্টই এই ভ্রমণের সময় সব কষ্টের চেয়ে বেশি বলে মনে হয়েছে আমাদের কাছে । তাই এখন থেকে আমরা নদীপথ ধরে চলবো, এই স্থির করা গেল । বনের জন্তু শিকার করে খাই আর মাঝে মাঝে কাফির বস্তি যদি পাই, সেখান থেকে মিষ্টি আলু, মুরগী প্রভৃতি সংগ্রহ করি ।
একবার অরেঞ্জ নদী পার হয়ে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরবর্ত্তী একটা কাফির বস্তীতে আশ্রয় নিয়েছি, সেইদিন দুপুরের পরে কাফির বস্তীর মোড়লের মেয়ে হঠাৎ ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়ল । আমরা দেখতে গেলাম— পাঁচ-ছ’বছরের একটা ছোট্ট উলঙ্গ মেয়ে মাটীতে পড়ে গড়াগড়ি দিচ্ছে— তার পেটে নাকি ভয়ানক ব্যাথা। সবাই কাঁদছে ও দাপাদাপি করছে। মেয়েটার ঘাড়ে নিশ্চয়ই দানো চেপেছে— ওকে মেরে না ফেলে ছাড়বে না। তাকে ও তার বাপ-মাকে জিজ্ঞেস করে এইটুকু জানা গেল, সে বনের ধারে গিয়েছিল— তারপর থেকে তাকে ভূতে পেয়েছে।আমি ওর অবস্থা দেখে বুঝলাম কোনো বনের পাঁচ ছ’বছরের একটা উলঙ্গ মেয়ে মাটীতে পড়ে গড়াগড়ি দিচ্ছে।ফল বেশী পরিমাণে খেয়ে ওর পেট কামড়াচ্ছে । তাকে জিজ্ঞেস করা হোল, কোনো বনের ফল সে খেয়েছিল কিনা? সে বল্লে— হ্যাঁ, খেয়েছিল । কাঁচা ফল? মেয়েটা বল্লে— ফল নয়, ফলের বীজ । সে ফলের বীজই খাদ্য ।
এক ডোজ হোমিওপ্যাথিক ওষুধে তার ভূত ছেড়ে গেল । আমাদের সঙ্গে ওষুধের বাক্স ছিল । গ্রামে আমাদের খাতির হয়ে গেল খুব । পনেরো দিন আমরা সে গ্রামের সর্দ্দারের অতিথি হয়ে রইলাম । ইলান্ড হরিণ শিকার করি আর রাত্রে কাফিরদের মাংস খেতে নিমন্ত্রণ করি । বিদায় নেবার সময় কাফির সর্দ্দার বল্লে— তোমরা সাদা পাথর খুব ভালোবাসো— না? বেশ খেলবার জিনিস । নেবে সাদা পাথর? দাঁড়াও দেখাচ্চি । একটু পরে সে একটা ডুমুর ফলের মতো বড় সাদা পাথর আমাদের হাতে এনে দিলে । জিম ও আমি বিস্ময়ে চমকে উঠলাম— জিনিসটা হীরে! খনি বা খনির ওপরকার পাথুরে মৃত্তিকাস্তর থেকে পাওয়া পালিশ-না-করা হীরের টুকরো!
কাফির সর্দ্দার বল্লে— এটা তোমরা নিয়ে যাও । ঐ যে দূরের বড় পাহাড় দেখচো, ধোঁয়া ধোঁয়া— এখান থেকে হেঁটে গেলে একটা চাঁদের মধ্যে ওখানে পৌঁছে যাবে । ঐ পাহাড়ের মধ্যে এ রকম সাদা পাথর অনেক আছে বলে শুনেচি । আমরা কখনো যাই নি, জায়গা ভালো নয়, ওখানে বুনিপ বলে উপদেবতা থাকে । অনেক চাঁদ আগেকার কথা, আমাদের গ্রামের তিনজন সাহসী লোক কারো বারণ না শুনে ঐ পাহাড়ে গিয়েছিল, আর ফেরেনি । আর একবার একজন তোমাদের মতো সাদা মানুষ এসেছিল, সেও অনেক, অনেক চাঁদ আগে । আমরা দেখিনি, আমাদের বাপ-ঠাকুরদাদাদের আমলের কথা । সে গিয়েও আর ফেরেনি ।
কাফির গ্রাম থেকে বার হয়েই পথে আমরা ম্যাপ মিলিয়ে দেখলাম— দূরের ধোঁয়া ধোঁয়া অস্পষ্ট ব্যাপারটা হচ্চে রিখটারসভেল্ড পর্বতশ্রেণী, দক্ষিণ-আফ্রিকার সর্বাপেক্ষা বন্য, অজ্ঞাত, বিশাল ও বিপদসঙ্কুল অঞ্চল । দু-একজন দুর্ধর্ষ দেশ-আবিষ্কারক বা ভৌগোলিক বিশেষজ্ঞ ছাড়া, কোনো সভ্য মানুষ সে অঞ্চলে পদার্পণ করেনি । ঐ বিস্তীর্ণ বনপর্ব্বতের অধিকাংশ স্থানই সম্পূর্ণ অজানা, তার ম্যাপ নেই, তার কোথায় কি আছে কেউ বলতে পারে না ।
জিম কার্টার ও আমার রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠল— আমরা দু’জনেই তখনি স্থির করলাম ওই অরণ্য ও পর্ব্বতমালা আমাদেরই আগমন প্রতীক্ষায় তার বিপুল রত্নভান্ডার লোকচক্ষুর আড়ালে গোপন করে রেখেছে, ওখানে আমরা যাবোই ।
কাফির গ্রাম থেকে রওনা হবার প্রায় সতে্রো দিন পরে আমরা পর্ব্বতশ্রেণীর পাদদেশে নিবিড় বনে প্রবেশ করলাম ।
পূর্ব্বেই বলেচি দক্ষিণ-আফ্রিকার অত্যন্ত দুর্গম প্রদেশে এই পর্ব্বতশ্রেণী অবস্থিত । জঙ্গলের কাছাকাছি কোনো কাফির বস্তি পর্য্যন্ত আমাদের চোখে পড়ল না । জঙ্গল দেখে মনে হোল কাঠুরিয়ার কুঠার আজ পর্য্যন্ত এখানে প্রবেশ করেনি । সন্ধ্যার কিছু পূর্ব্বে আমরা জঙ্গলের ধারে এসে পৌঁছেছিলাম । জিম কার্টারের পরামর্শ মতো সেইখানেই আমরা রাত্রে বিশ্রামের জন্য তাঁবু খাটালাম । জিম জঙ্গলের কাঠ কুড়িয়ে আগুন জ্বাললে, আমি লাগলাম রান্নার কাজে । সকালের দিকে একজোড়া পাখি মেরেছিলাম, সেই পাখি ছাড়িয়ে তার রোস্ট করবো এই ছিল মতলব । পাখী ছাড়ানোর কাজে একটু ব্যস্ত আছি, এমন সময় জিম বল্লে— পাখী রাখো । দু’পেয়ালা কফি করো তো আগে ।
আগুন জ্বালাই ছিল । জল গরম করতে দিয়ে আবার পাখি ছাড়াতে বসেছি, এমন সময় সিংহের গর্জ্জন একেবারে অতি নিকটে শোনা গেল । জিম বন্দুক নিয়ে বেরুল, আমি বল্লাম— অন্ধকার হয়ে আসছে, বেশি দূর যেও না । তারপরে আমি পাখি ছাড়াচ্চি— কিছুদূরে জঙ্গলের বাইরেই দু’বার বন্দুকের আওয়াজ শুনলুম । একটুখানি থেমে আবার আর একটা আওয়াজ । তারপরেই সব চুপ। মিনিট দশ কেটে গেল, জিম আসে না দেখে আমি নিজের রাইফেলটা নিয়ে যেদিক থেকে আওয়াজ এসেছিল, সেদিকে একটু যেতেই দেখি জিম আসচে— পেছনে কি একটা ভারী মতো টেনে আনচে । আমায় দেখে বল্লে— ভারী চমৎকার ছালখানা। জঙ্গলের ধারে ফেলে রাখলে হায়েনাতে সাবাড় করে দেবে। তাঁবুর কাছে টেনে নিয়ে যাই চল।
দু’জনে টেনে সিংহের প্রকান্ড দেহটা তাঁবুর আগুনের কাছে নিয়ে এসে ফেললাম । তারপর ক্রমে রাত হোল । খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা শুয়ে পড়লুম।
অনেক রাত্রে সিংহের গর্জ্জনে ঘুম ভেঙে গেল । তাঁবু থেকে অল্প দূরেই সিংহ ডাকচে । অন্ধকারে বোঝা গেল না ঠিক কতদূরে । আমি রাইফেল নিয়ে বিছানায় উঠে বসলাম । জিম শুধু একবার বল্লে— সন্ধ্যাবেলার সেই সিংহটার জুড়ি।
বলেই সে নির্ব্বিকারভাবে পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল । আমি তাঁবুর বাইরে এসে দেখি আগুন নিভে গিয়েছে । পাশে কাঠকুটো ছিল, তাই দিয়ে আবার জোর আগুন জ্বাললাম । তারপর আবার এসে শুয়ে পড়লাম ।
পরদিন সকালে উঠে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেলাম । কিছুদূর গিয়ে কয়েকজন কাফিরের সঙ্গে দেখা হল। তারা হরিণ শিকার করতে এসেচে । আমরা তাদের তামাকের লোভ দেখিয়ে কুলী ও পথপ্রদর্শক হিসেবে সঙ্গে নিতে চাইলাম ।
তারা বল্লে— তোমরা জানো না তাই ও কথা বলছ । এ জঙ্গলে মানুষ আসে না । যদি বাঁচতে চাও তো ফিরে যাও । ঐ পাহাড়ের শ্রেণী অপেক্ষাকৃত নীচু, ওটা পার হয়ে মধ্যে খানিকটা সমতল জায়গা আছে, ঘন বনে ঘেরা, তার ওদিকে আবার এর চেয়েও উঁচু পর্ব্বতশ্রেণী । ঐ বনের মধ্যে সমতল জায়গাটা বড় বিপজ্জনক, ওখানে বুনিপ থাকে। বুনিপের হাতে পড়লে আর ফিরে আসতে হবে না । ওখানে কেউ যায় না । আমরা তামাকের লোভে ওখানে যাব মরতে? ভালো চাও তো তোমরাও যেও না ।
আমরা জিজ্ঞেস করলাম— বুনিপ কি?
তারা জানে না । তবে তারা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলে বুনিপ কী না জানলেও, সে কি অনিষ্ট করতে পারে সেটা তারা খুব ভালো রকমই জানে ।
ভয় আমাদের ধাতে ছিল না, জিম কার্টারের তো একেবারেই না । সে আরও বিশেষ করে জেদ ধরে বসল । এই বুনিপের রহস্য তাকে ভেদ করতেই হবে— হীরে পাই বা না পাই । মৃত্যু যে তাকে অলক্ষিতে টানচে তখনও যদি বুঝতে পারতাম।
বৃদ্ধ এই পর্যন্ত বলে একটু হাঁপিয়ে পড়ল। শঙ্করের মনে তখন অত্যন্ত কৌতূহল হয়েছে, এ ধরনের কথা সে আর কখনো শোনেনি। মুমূর্ষু ডিয়েগো আলভারেজের জীর্ণ পরিচ্ছদ ও শিরাবহুল হাতের দিকে চেয়ে, তার পাকা ভুরু জোড়ার নিচেকার ইস্পাতের মতো নীল দীপ্তিশীল চোখ দুটোর দিকে চেয়ে শঙ্করের মন শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় ভরে উঠল।
সত্যিকারের মানুষ বটে একজন!
আলভারেজ বল্লে— আর এক গ্লাস জল।
জল পান করে বৃদ্ধ আবার বলতে শুরু করলে—
হ্যাঁ, তারপরে শোনো। ঘোর বনের মধ্যে আমরা প্রবেশ করলাম । কত বড় বড় গাছ, বড় বড় ফার্ন, কত বিচিত্র বর্ণের অর্কিড ও লায়ানা, স্থানে স্থানে সে বন নিবিড় ও দুষ্প্রবেশ্য । বড় বড় গাছের নীচেকার জঙ্গল এতই ঘন । বঁড়শির মতো কাঁটা গাছের গায়ে, মাথার উপরকার পাতায় পাতায় এমন জড়াজড়ি যে সূর্যের আলো কোনো জন্মে সে জঙ্গলে প্রবেশ করে কিনা সন্দেহ । আকাশ দেখা যায় না । অত্যন্ত বেবুনের উত্‍পাত জঙ্গলের সর্বত্র, বড় গাছের ডালে দলে দলে শিশু, বালক, বৃদ্ধ, যুবা নানারকমের বেবুন বসে আছে— অনেক সময় দেখলাম মানুষের আগমন তারা গ্রাহ্য করে না । দাঁত খিঁচিয়ে ভয় দেখায়— দু-একটা বুড়ো সর্দার বেবুন সত্যিই হিংস্র প্রকৃতির, হাতে বন্দুক না থাকলে তারা অনায়াসেই আমাদের আক্রমণ করতো । জিম কার্টার বল্লে — অন্ততঃ আমাদের খাদ্যের অভাব হবে না কখনো এ জঙ্গলে ।

সাত-আটদিন সেই নিবিড় জঙ্গলে কাটল । জিম কার্টার ঠিকই বলেছিল, প্রতিদিন একটা করে বেবুন আমাদের খাদ্য যোগান দিতে দেহপাত করতো । উঁচু পাহাড়টা থেকে জঙ্গলের নানাস্থানে ছোট বড় ঝরনা নেমে এসেচে, সুতরাং জলের অভাবও ঘটল না । একবার কিন্তু এতে বিপদও ঘটেছিল। একটা ঝরনার ধারে দুপুরবেলা এসে আগুন জ্বেলে বেবুনের দাপনা ঝলসাবার ব্যবস্থা করচি, জিম গিয়ে তৃষ্ণার ঝোঁকে ঝরনার জল পান করলে । তার একটু পরেই তার ক্রমাগত বমি হতে শুরু করল । পেটে ভয়ানক ব্যথা । আমি একটা বিজ্ঞান জানতাম, আমার সন্দেহ হওয়াতে ঝরনার জল পরীক্ষা করে দেখি, জলে খনিজ আর্সেনিক মেশানো আছে । উপর পাহাড়ের আর্সেনিকের স্তর ধুয়ে ঝরনা নেমে আসছে নিশ্চয়ই । হোমিওপ্যাথিক বাক্স থেকে প্রতিষেধক ওষুধ দিতে সন্ধ্যার দিকে জিম সুস্থ হয়ে উঠল ।
বনের মধ্যে ঢুকে কেবল এক বেবুন ও মাঝে মাঝে দু-একটা বিষধর সাপ ছাড়া অন্য কোনো বন্যজন্তুর সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয়নি । পাখি আর প্রজাপতির কথা অবশ্য বাদ দিলাম । কারণ এই সব ট্রপিক্যাল জঙ্গল ছাড়া এত বিচিত্র বর্ণ ও শ্রেণীর পাখি ও প্রজাপতি আর কোথাও দেখতে পাওয়া যাবে না । বিশেষ করে বন্যজন্তু বলতে যা বোঝায়, তারা সে পর্যায়ে পড়ে না ।
প্রথমেই রিখটারসভেল্ড পর্ব্বতশ্রেণীর একটা শাখা পর্বত আমাদের সামনে পড়ল, সেটা মূল ও প্রধান পর্বতের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে অবস্থিত বটে, কিন্তু অপেক্ষাকৃত নীচু । সেটা পার হয়ে আমরা একটা বিস্তীর্ণ বনময় উপত্যকায় নেমে তাঁবু ফেললাম । নদী দেখে আমার ও জিমের আনন্দ হল, এই সব নদীর তীর থেকেই অনেক সময় খনিজ দ্রব্যের সন্ধান পাওয়া যায় ।
নদীর নানাদিকে আমরা বালি পরীক্ষা করে বেড়াই, কিছুই কোথাও পাওয়া যায় না । সোনার একটা রেণু পর্য্যন্ত নেই নদীর বালিতে । আমরা ক্রমে হতাশ হয়ে পড়লুম । তখন প্রায় কুড়ি-বাইশদিন কেটে গিয়েচে । সন্ধ্যার সময় কফি খেতে খেতে জিম বল্লে — দেখ, আমার মন বলছে এখানে আমরা সোনার সন্ধান পাব । থাক এখানে আর কিছুদিন ।
আরও কুড়িদিন কাটল । বেবুনের মাংস অসহ্য ও অত্যন্ত অরুচিকর হয়ে উঠেছে । জিমের মতো লোকও হতাশ হয়ে পড়ল । আমি বল্লাম — আর কেন জিম, চল ফিরি এবার । কাফির গ্রামে আমাদের ঠকিয়েছে । এখানে কিছু নেই ।
জিম বল্লে — এই পর্ব্বতশ্রেণীর নানা শাখা আছে, সবগুলো না দেখে যাব না ।
একদিন পাহাড়ী নদীটার খাতের ধারে বসে বালি চালতে চালতে পাথরের নুড়ির রাশির মধ্যে অর্ধপ্রোথিত একখানা হলদে রঙের ছোট পাথর আমি ও জিম একসঙ্গেই দেখতে পেলাম । আমাদের মুখ আনন্দ ও বিস্ময়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠল । জিম বল্লে — ডিয়েগো, পরিশ্রম এতদিনে সার্থক হল, চিনেছ তো?
আমিও বুঝেছিলাম । বল্লাম — হ্যাঁ । কিন্তু জিনিসটা নদীস্রোতে ভেসে আসা । খনির অস্তিত্ব নেই এখানে ।
পাথরখানা দক্ষিণ আফ্রিকার বিখ্যাত হলদে রঙের হীরের জাত । অবশ্য খুব আনন্দের কোনো কারণ ছিল না, কারণ এতে মাত্র এটাই প্রমাণ হয় যে, এই বিশাল পর্ব্বতশ্রেণীর কোনো অজ্ঞাত, দুর্গম অঞ্চলে হলদে হীরের খনি আছে । নদীস্রোতে ভেসে এসেচে তা থেকে একটা স্তরের একটা টুকরো । সে মূল খনি খুঁজে বার করা অমানুষিক পরিশ্রম, ধৈর্য্য ও সাহস সাপেক্ষ ।
সে পরিশ্রম, সাহস ও ধৈর্য্যের অভাব আমাদের ঘটতো না, কিন্তু যে দৈত্য ঐ রহস্যময় বনপর্ব্বতের অমূল্য হীরকখনির প্রহরী, সে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে আমাদের বাধা দিলে ।
একদিন আমরা বনের মধ্যে একটা পরিষ্কার জায়গায় বসে সন্ধ্যার দিকে বিশ্রাম করছি, আমাদের সামনে সেই জায়গাটাতে একটা তালগাছ, তালগাছের তলায় গুঁড়িটা ঘিরে খুব ঘন বন-ঝোপ । হঠাৎ আমরা দেখলাম কিসে যেন অতবড় তালগাছটা এমন নাড়া দিচ্চে যে, তার ওপরকারের শুকনো ডালপালাগুলো খড়খড় করে নড়ে উঠছে, যেমন নড়ে ঝড় লাগলে । গাছটাও সেই সঙ্গে নড়চে ।
আমরা আশ্চর্য্য হয়ে গেলাম । বাতাস নেই কোনোদিকে, অথচ তালগাছটা নড়চে কেন? আমাদের মনে হোল কে যেন তালগাছের গুঁড়িটা ধরে ঝাঁকি দিচ্চে । জিম তখনই ব্যাপারটা কি তা দেখতে গুঁড়ির তলায় সেই জঙ্গলটার মধ্যে ঢুকলো ।
সে ওর মধ্যে ঢুকবার অল্পক্ষণ পরেই আমি একটা আর্ত্তনাদ শুনতে পেয়ে রাইফেল নিয়ে ছুটে গেলুম । ঝোপের মধ্যে ঢুকে দেখি জিম রক্তাক্ত দেহে বনের মধ্যে পড়ে আছে — কোনো ভীষণ বলবান জন্তুতে তার মুখের সামনে থেকে বুক পর্য্যন্ত ধারালো নখ দিয়ে চিরে ফেঁড়ে ফেলেচে — যেমন পুরাণো বালিশ ফেঁড়ে তুলো বার করে, তেমনি । জিম্ শুধু বল্লে— সাক্ষাৎ শয়তান! মূর্ত্তিমান শয়তান…
 হাত দিয়ে ইঙ্গিত করে বল্লে— পালাও— পালাও-
 তারপরেই জিম্ মারা গেল । তালগাছের গায়ে দেখি যেন কিসের মোটা, শক্ত চোঁচ লেগে আছে। আমার মনে হোল কোনো ভীষণ বলবান জানোয়ার তালগাছের গায়ে গা ঘষছিল, গাছটা ওরকম নড়ছিল সেই জন্যেই । জন্তুটার কোনো পাত্তা পেলাম না । জিমের দেহ ফাঁকা জায়গায় বার করে আমি রাইফেল হাতে ঝোপের ওপারে গেলাম । সেখানে গিয়ে দেখি মাটির ওপরে কোনো অজ্ঞাত জন্তুর পায়ের চিহ্ন, তার মোটে তিনটে আঙুল পায়ে । কিছুদূর গেলাম পায়ের চিহ্ন অনুসরণ করে, জঙ্গলের মধ্যে কিছুদূর গিয়ে গুহার মুখে পদচিহ্নটা ঢুকে গেল । গুহার প্রবেশ পথের কাছে শুকনো বালির ওপর ওই অজ্ঞাত ভয়ঙ্কর জানোয়ারটার বড় বড় তিন আঙুলে থাবার দাগ রয়েচে ।
 তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে । সেই জনহীন অরণ্যভূমি ও পর্ব্বতবেষ্টিত অজ্ঞাত উপত্যকায় একা দাঁড়িয়ে আমি এক অজ্ঞাততর ভীষণ বলবান জন্তুর অনুসরণ করচি । ডাইনে চেয়ে দেখি প্রায়ান্ধকার সন্ধ্যায় সুউচ্চ ব্যাসাল্টের দেওয়াল খাড়া উঠেচে প্রায় চার হাজার ফুট, বনে বনে নিবিড়, খুব উঁচুতে পর্ব্বতের বাঁশবনের মাথায় সামান্য যেন একটু রাঙা রোদ —কিম্বা হয়তো আমার চোখের ভুল, অনন্ত আকাশের আভা পড়ে থাকবে।
 ভাবলাম—এ সময় গুহার মধ্যে ঢোকা বা এখানে দাঁড়িয়ে থাকা বিবেচনার কাজ হবে না। জিমের দেহ নিয়ে তাঁবুতে ফিরে এলুম। সারারাত তার মৃতদেহ নিয়ে আগুন জ্বেলে, রাইফেল্ তৈরি রেখে বসে রইলুম।
 পরদিন জিমকে সমাধিস্থ করে আবার ওই জানোয়ারটার খোঁজে বার হলাম। কিন্তু মুস্কিল এই যে, সে গুহা এবং সেই তালগাছটা পর্য্যন্ত অনেক খুঁজেও কিছুতেই বার করতে পারলুম না। ও রকম অনেক গুহা আছে পর্ব্বতের নানা জায়গায়। সন্ধ্যার অন্ধকারে কোন্ গুহা দেখেছিলাম কে জানে?
 সঙ্গীহীন অবস্থায় সেই মহাদুর্গম রিখটারসভেল্ড পর্ব্বতশ্রেণীর বনের মধ্যে থাকা চলে না। পনেরো দিন হেঁটে সেই কাফির বস্তিতে পৌঁছুলাম। তারা চিনতে পারলে, খুব খাতির করলে। তাদের কাছে জিমের মৃত্যুকাহিনী বল্লুম।
 শুনে তাদের মুখ ভয়ে কেমন হয়ে গেল—ছোট ছোট চোখ ভয়ে বড় হয়ে উঠল। বল্লে—সর্বনাশ! বুনিপ্। ওই ভয়েই ওখানে কেউ যায় না।
 কাফির বস্তি থেকে আর পাঁচদিন হেঁটে অরেঞ্জ নদীর ধারে এসে একখানা ডাচ্ লঞ্চ পেলাম। তাতে করে এসে সভ্য জগতে পৌঁছুলাম।
 আমি আর কখনো রিখটারসভেল্ড পর্ব্বতের দিকে যেতে পারিনি। চেষ্টা করেছিলাম অনেক। কিন্তু বুয়র যুদ্ধ এসে পড়ল। যুদ্ধে গেলাম। আহত হয়ে প্রিটোরিয়ার হাসপাতালে অনেকদিন রইলাম। তারপর সেরে উঠে একটা কমলালেবুর বাগানে কাজ পেয়ে সেখানেই এতদিন ছিলাম।
 বছর চার-পাঁচ শান্ত জীবন যাপন করবার পরে, ভালো লাগলো না, তাই আবার বার হয়েছিলাম। কিন্তু বয়স হয়ে গিয়েচে অনেক, ইয়্যাংম্যান, এবার আমার চলা বোধ হয় ফুরুবে।
 এই ম্যাপখানা তুমি রাখো। এতে রিখটারসভেল্ড পর্ব্বত ও যে নদীতে আমরা হীরা পেয়েছিলাম, মোটামুটি ভাবে আঁকা আছে। সাহস থাকে, সেখানে যেও, বড় মানুষ হবে। বুয়র যুদ্ধের পর ওই অঞ্চলে ওয়াই নদীর ধারে দু-একটা ছোট বড় হীরার খনি বেরিয়েচে। কিন্তু আমরা যেখানে হীরা পেয়েছিলাম তার সন্ধান কেউ জানে না। যেও তুমি।
 ডিয়েগো আলভারেজ গল্প শেষ করে আবার অবসন্ন ভাবে বালিশের গায়ে ভর দিয়ে শুয়ে পড়ল।