PK

লেবেগ ইনটেগ্রেশন, রিমান ইনটেগ্রেশন, হেনরি লেবেগের উপমা

লেবেগ ইনটেগ্রেশন, রিমান ইনটেগ্রেশন, হেনরি লেবেগের উপমা


আমরা সবাই যারা সায়েন্স অথবা ইঞ্জিনীয়ারিং এ পড়ি ,তাদেরকে গণিত শিখতেই হয়, তারা সবাই ইনটেগ্রেশনের (সমাকলন) সাথে পরিচিত । ইনটেগ্রেশনের বাংলা করলে অর্থ দাঁড়াবে একত্র করা বা একীভূত করা (অনেক জিনিস কে একসাথে করা ) । ম্যাথমেটিক্সের ক্ষেত্রেও অনেকটা একই রকম অর্থে ইনটেগ্রেশনের কথা
ভাবলে হয়ত ভুল হবে না । ইনটেগ্রেশন কে অনেকে এভাবে ভেবেও মাথায় ঢোকায় যে , এটা এমন একটা গাণিতিক পদ্ধতি যা দিয়ে বিভিন্ন জিনিসের , বিভিন্ন বাস্তব জগতের বস্তু (দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় মাত্রায় যা কিনা আমরা খালি চোখে দেখতে পারি,অনুভব করতে পারি) যেমন সমতল, ফানেল, রুটি বেলার বেলন, ঘুড়ির নাটাই, বাড়িঘর , চতুর্ভুজাকৃতির, ত্রিভুজাকৃতির, রম্বসাকৃতির বস্তুসমূহের ক্ষেত্রফল কিংবা আয়তন নির্ণয় করতে পারি । খুব শুরুতে আমরা যখন ইনটেগ্রেশন শিখি , আমরা শুরু করি বিভিন্ন ফাংশনের ইনটেগ্রেশন বের করা দিয়ে । ওইসব বস্তুকে আসলে গাণিতিক ফাংশনের মাধ্যমে প্রকাশ করে তারপর সেইসব ফাংশনের ইনটেগ্রেশন করে আমরা ক্ষেত্রফল কিংবা আয়তন নির্ণয় করি । দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় মাত্রা পর্যন্ত আমরা ফাংশনের গ্রাফ এঁকে আমাদের তৃতীয় মাত্রীয় বোধগম্য জগতে চিন্তা করতে পারি, মাত্রা এর থেকে বড় হলে কিন্তু কল্পনা করা কঠিন হয়ে পড়ে, আয়তনের ধারণাও জটিল হয়ে পড়ে । কিন্তু ইনটেগ্রেশন শিখে ফেললে তা ব্যবহার করে সেইসব অকল্পনীয় বস্তুর উচ্চমাত্রীয় আয়তনও আমরা নির্ণয় করে ফেলতে পারি । এখানেই আসলে গণিতের মজা , যা কিনা আমরা ধরে ছুঁয়ে দেখতে পারি না, এমনকি কল্পনা করতেও কষ্ট হয় ; কিছু গাণিতিক সমীকরণ দিয়ে ধারণা করে , বৈশিষ্ট্য বুঝে নিয়ে ফেলতে পারি । যাই হোক, আমরা জানি ফাংশনের থাকে ডোমেইন আর রেঞ্জ । ডোমেইন হল সেই সেট যার সদস্যদের জন্য ফাংশন মান নির্ণয় করবে । আর ডোমেইন এর প্রত্যেক সদস্যের জন্য যে মান গুলো পাওয়া যায় , সেগুলো দিয়ে গঠিত সেটই হল রেঞ্জ । আমরা ইনটেগ্রেশন করার সময় প্রথমে ফাংশনের ডোমেইন কে অনেক ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে নিয়ে থাকি । সবার নিশ্চয়ই মনে আছে x-y সমতলে ক্ষেত্রফল বের করার জন্য ইনটেগ্রেশন করার সময় আমরা x অক্ষকে খুবই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে ভাগ করে নিয়েছিলাম । সেইসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগের জন্য আমরা খুবই ক্ষুদ্র প্রস্থবিশিষ্ট আয়তক্ষেত্র চিন্তা করে তার ক্ষেত্রফল বের করেছিলাম, তারপর সবগুলো ক্ষেত্রফল কে যোগ করে পুরো ক্ষেত্রফল বের করেছিলাম । উচ্চতর মাত্রার জন্যও অনেকটা একই রকম । ডোমেইনকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ কর , তারপর সেই ছোট ছোট ভাগের মধ্যে ফাংশনের(একচলকীয় , দ্বিচলকীয় কিংবা বহুচলকীয়) মান (রেঞ্জের সদস্য) কে চিন্তা করে যে ছোট ছোট জ্যামিতিক বস্তু পাও, তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আয়তন নির্ণয় করে সব আয়তন কে আবার এক সাথে যোগ করে সম্পূর্ণ আয়তন বের কর । এই পুরো গাণিতিক প্রনালীকেই আমরা বলি ইনটেগ্রেশন । আসলে এটা হল রিমান ইনটেগ্রেশন। জার্মান গণিতবিদ বার্নার্ড রিমানের নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে ।

যাই হোক এখন আসল কথায় আসি । এই লেখাটা আমি আসলে ইনটেগ্রেশন শেখানোর জন্য লিখছি না । তাদের জন্য লিখছি যাদের উপমা অনেক পছন্দ, যারা চিন্তা করতে ভালোবাসে, একটু আধটু গণিত নিয়েও ঘাটাঘাটি করেছে ।ইন্টেগ্রেশন যারা করে নি কখনও তাদের জন্য হয়ত বোঝা কঠিন হয়ে পড়বে । আমি নতুন এক ইনটেগ্রেশনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই যার নাম হল লেবেগ ইনটেগ্রেশন । দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে সায়েন্স ইঞ্জিনীয়ারিং এ পড়েও অধিকাংশ মানুষই এটার সাথে পরিচিত হয় না । হয়ত সাধারণ কাজে এর তেমন ব্যবহারিক প্রয়োগ নেই বলে সবাই ভাবে । যাই হোক আমি লেবেগ ইনটেগ্রেশন এর প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষিতে এই আলোচনা উথ্বাপন করতেও চাচ্ছি না । বরং ফরাসী গণিতবিদ হেনরি লেবেগের প্রথাবিরুদ্ধ চিন্তার বাইরে গিয়ে নতুন এই লেবেগ ইনটেগ্রেশনের আবিষ্কারের গল্পই বলতে চাচ্ছি । উপরে ডোমেইন প্রথমে ভাগ করে তারপর রেঞ্জ নিয়ে চিন্তা করার যে রিমান ইনটেগ্রেশন এর ধারণা সেটাই শতকের পর শতক ইনটেগ্রেশনের প্রথা হয়ে ছিল । কিন্তু এই পদ্ধতিতে বেশ কিছু অসংগতিপূর্ণ ফলাফল ছিল । এবং সেগুলো সমাধান করতে চাইলে লেবেগ ইনটেগ্রেশন ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই । Measure ( পরিমাপ ) এবং Measurable স্পেস নিয়ে যারা পড়াশোনা করছে তাদের জন্যও লেবেগ ইনটেগ্রেশন বোঝাটা অনেকটা অবধারিত । Lebesgue Integration, Measure and Probability দিয়ে গুগলে সার্চ করলে অনেক বিস্তারিত তথ্য জানা যেতে পারে ।

এখন লেবেগের উপমায় আসি । একটা গল্প দিয়ে শুরু করি । ধরা যাক একজন মুদী দোকানদার আছে । সারাদিন সে বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করছে । যারা কিনছে তারা কেনার পরে মুদী দোকানদার কে টাকা দিচ্ছে । ১ টাকা, ৫ টাকা, ১০ টাকা, ২০ টাকা, ৫০ টাকা , ১০০ টাকা, ৫০০ টাকার বিভিন্ন নোট এ তারা দোকানদারকে দাম দিচ্ছে । একেক জন তাকে একেক নোটে একেক ভাবে জিনিসের দাম দিচ্ছে । ধরা যাক ৫০ টাকার একটা জিনিস , ৫০ টাকাকে অনেকে ৫ টা দশ টাকার নোটে , অনেকে আবার ৩ টা ১০ টাকার নোট , একটা ২০ টাকার নোটে দিচ্ছে । এভাবে যে কোন দাম বা সাংখ্যিক মূল্য কে ভিন্ন ভিন্ন নোটের বিন্যাসে দেয়া সম্ভব তাই তো । যাই হোক , দিনের শেষে দোকানদার কে দিনে তার সর্বমোট আয় হিসাব করতে হবে । সে কিভাবে হিসাব করবে ? সবাই নিশ্চয় ই বলছ এটা তো সবাই জানে দোকানদার কি করবে । সে প্রত্যেকটা নোট ; ১০ টাকা, ২০ টাকা, ৫০ টাকা , ১০০ টাকা, ৫০০ টাকার নোট আলাদা করবে , প্রত্যেকটা কয়টা করে আছে হিসাব করবে , তারপর তো গুণ আর যোগ । এই অংক তো ছোট বেলাতেই মানুষ শিখে , দোকানদাররা তো অংক না শিখেও পারে ।

কিন্তু একটু থাম । ধর আমাদের দোকানদার সেভাবে গণনা করছে না । ধরা যাক সে সকাল ৮ টায় দোকান খুলেছে , আর রাত ৮ টায় দোকান বন্ধ করে হিসাব করতে বসেছে । সে করছে কি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রতি ঘন্টায়, প্রতি মিনিটে প্রতি সেকেন্ডে যে ক্রমে তার কাছে টাকার নোট গুলো এসেছে সেই ক্রমেই যোগ করছে । মানে হল, ধর সকাল ৮ টা ২০ এ একজন তাকে ৩ টা ৫০ টাকার নোট , ২টা ১০ টাকার নোট দিয়েছে, ৫ টা ১০০ টাকার নোট দিয়েছে, তারপর ৯ টায় তাকে একজন ৬ টা ১০ টাকার নোট , ২ টা ২০ টাকার নোট দিয়েছে , এভাবে …… প্রত্যেক ঘন্টায় তার কাছে যে ক্রমে নোটগুলো এসেছে সেই ক্রমেই সে নোটগুলো সাজিয়ে রেখেছে , ১০ টাকা, ২০ টাকা, ৫০ টাকা , ১০০ টাকা, ৫০০ টাকার নোট আলাদা না করে , যেভাবে সময়ানুসারে নোটগুলো এসেছে সেভাবে সাজিয়ে রেখেছে । এবং এখন গোনার সময় সে ( ৩ টা ৫০ টাকা + ২টা ১০ টাকা) + (৬ টা ১০ টাকা + ২ টা ২০ টাকা) + …… করে গুনছে । ভুল না করলে সে তো শুদ্ধ উত্তর ই পাবে । কিন্তু তাকে আমরা কি বুদ্ধিমান বলব !!!

এখন ইনটেগ্রেশনের সাথে এই গল্পের কি সম্পর্ক তা মনে হয় কারো মাথায় ঢুকছে না । রিমান ইনটেগ্রেশন আসলে এই গাধা দোকানদারের মতই। কারণ আগেই বলেছি আমরা রিমান ইনটেগ্রেশনে কি করছি , প্রথমে ডোমেইনকে ভাগ করছি , এই প্রত্যেকটা ভাগ কে দোকানদারের প্রত্যেক ঘন্টার সাথে তুলনা কর , আমরা ডোমেইন এর সেই ক্ষুদ্র ভাগের জন্য রেঞ্জে অবস্থিত ফাংশনের মান চিন্তা করেছি , ফাংশনের মান বিভিন্ন হতে পারে, যেমন আমাদের দোকানদারকে ক্রেতা বিভিন্ন নোটের বিন্যাসে দাম দিতে পারে । তারমানে দোকানদার যেরকম সময়ের ক্রমানুসারে একটা একটা করে আসা নোট যোগ করছে , রিমান ইনটেগ্রেশনেও আমরা ডোমেইনে যে ক্রমে সদস্যগুলোকে সাজানো আছে সেই ক্রমে ফাংশনের যে বিভিন্ন মান আসে সেগুলোর সাহায্যে ইনটেগ্রেশন করছি । এখনও যদি কারো মাথায় না ঢুকে থাকে , তাহলে x অক্ষে x এর বিভিন্ন মানকে বিভিন্ন সময়ের সাথে তুলনা কর । আমরা কি করছি x এর কোন একটা ইন্টারভাল (x1 , x2 ) তে যখন ফাংশনের ইনটেগ্রেশন করছি তখন x1 আর x2 এর মধ্যবর্তী অংশকে x1 এর দিক থেকে শুরু করে ছোট ছোট ভাগ করে তাদের জন্য ফাংশনের মান চিন্তা করে ছোট ছোট আয়তক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল চিন্তা করে যোগ করছি । এটা কি দোকানদারের গাধামীর সাথে তুলনীয় ? এই উপমা আসলে চিন্তা করেছেন হেনরি লেবেগ । তিনি এই দোকানদার কে বলছেন unsystematic বা অগোছালো । দোকানদারের উচিত নোটগুলো গুছিয়ে নিয়ে হিসাব করা ।

তেমনি ইনটেগ্রেশন করার সময় ও প্রথমে ডোমেইন নিয়ে চিন্তা না করে রেঞ্জে ফাংশনের বিভিন্ন মান গুলোকে গুছিয়ে নেয়ার চিন্তা করতে পারি । এবং সেইসব মান ডোমেইন এর কোন কোন ইন্টারভাল দেয় এবং সেই সব ইন্টারভালে পরিমাপযোগ্যতা (Measurability) চিন্তা করে সমষ্টি বের করে ইনটেগ্রেশন করা টা বুদ্ধিমানের কাজ । এখন নিশ্চয় ই সবাই কিছুটা হলেও বুঝতে পারছ । আমি এতক্ষণ ধরে কি নিয়ে কথা বললাম । লেবেগ ইনটেগ্রেশন এর বিভিন্ন থিওরেম অবশ্য অনেক কঠিন আর জটিল বলেই হয়ত অধিকাংশ কোর্স কারিকুলামে একে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না । কিন্তু লেবেগ কিভাবে এর সূত্রপাত ঘটিয়েছেন তা জানলে এর প্রতি বিপুল আগ্রহ জন্মানটা স্বাভাবিক ।
Credit: Ganitpathsala