PK

তাঁদের ছোট ছোট গল্প

রামানুজনের ১৭২৯

হার্ডির সাথে কাজ করার সময় রামানুজন একবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে হাসপাতালে দেখতে যান হার্ডি। কিন্তু ঢেকি তো স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, আর হার্ডি তো গেছে কেবল হাসপাতালে। কী জিজ্ঞেস করবেন ব্যাটা তোর শরীর কেমন, কী খাবি এইসব- তার বালাই নেই, গিয়েই বলে বসলেন, “আজকে আমি যে
ট্যাক্সিতে করে আসলাম তার সংখ্যাটা বেশ বেরসিক, ১৭২৯।

এর এমন কোন আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য নাই।” আমাদের রামানুজন দাদা আরেক কাঠি সরেস, কী একটু সুস্থ হবার কথা ভাববেন, ভাল-মন্দ খাওয়া-দাওয়া করবেন, তা না কেবল সংখ্যা নিয়ে মাতামাতি। বলে বসলেন, “আরে বলেন কি!! এর মত সংখ্যা আর একটি পাবেন না। এটি হল সেই ক্ষুদ্রতম সংখ্যা যাকে দুই ভাবে দুটি সংখ্যার ঘনের যোগফল আকারে প্রকাশ করা যায়: ১৭২৯ = ১^৩ + ১২^৩ = ৯^৩ + ১০^৩”

বিস্ময় বালক গাউস

ইংরেজিতে একটি শব্দ আছে prodigy -এর মানে হল ছোট বয়স থেকেই যে কোন একটি বিশেষ বিষয়ে অপ্রত্যাশিত পারদর্শিতা প্রদর্শন করে। গণিতের রাজপুত্র কার্ল ফ্রেড্রিক গাউস ছিলেন এক প্রডিজি। গাউস তখন অনেক ছোট, কিন্তু নিজের প্রতিভায় হার মানিয়েছেন সবাইকে। স্কুলের শিক্ষকেরাও তাঁকে নিয়ে ভয়ংকর বিপদে, গণিত নিয়ে যে রীতিমত খেলা করে বেড়াতেন তিনি। একদিন এক শিক্ষক তাঁকে জব্দ করার ফন্দি আঁটলেন। ক্লাসে এসে বললেন, “শোন ছাত্ররা, ১+২+…+১০০ – এই যোগফলটি বের কর।”
ছোট ছোট বাচ্চাদের তো তখন ত্রাহি মাম দশা। এতগুলো সংখ্যা যোগ করতে সবার গলদর্ঘম অবস্থা। কিন্তু একটু পরে দাঁড়িয়ে পড়লেন গাউস, তাঁর ক্লাসের কাজের খাতাটি নিয়ে গেলেন স্যারের কাছে।
খাতায় যা লিখা ছিল তা দেখে অবাক ঐ শিক্ষক-
S = 1 + 2 + 3 + … + 100
S = 100 + 99 + 98 + … +1
=> 2S = 101 + 101 + 101 + … +101 = 100.101
=> S =5050

ভনের ভাঙন

জন ভন নিউম্যান- এক মানুষই বটে। বিজ্ঞানের জগতে খুব কম জায়গাই আছে যেটা তাঁর অত্যাচার থেকে রেহাই পেয়েছে। কোন কাজ-কম্ম তো নেই, বসে বসে সেই সেটতত্ত্ব থেকে শুরু করে কম্পিউটার স্ট্রাকচার, এলগরিদম, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ছাত্রদের জ্বালানোর সমূহ উপায় বের করে গেছেন এই লোক। তো তাঁর এতমুখী প্রতিভা দেখে হিংসায় “জ্বলে পুড়ে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়” জাতীয় কিছু সহকর্মীও তাঁর ছিল। তো ভন বাবু একদিন বসে আছে প্রফেসরদের কমন রুমে, শীতের সকালে গরম চা আর ভাপা পিঠা(!) খাচ্ছেন। একদিন তাঁর এরকমই এক সহকর্মী তাঁকে খোঁচা দিয়ে জ্বালাবার জন্য একটা প্রশ্ন করলেন তাঁকে,
“আচ্ছা স্যার, একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো- ১৫০ কিলোমিটার দূর দাঁড়ানো দুটি ট্রেন একই রেললাইন বরাবর একে অপরের দিকে ছুটে আসছে। এদের মাঝখানে আছে একটি মাছি। মাছিটি একবারে এ পাশের ট্রেন থেকে উড়তে শুরু করে ও পাশের ট্রেন পর্যন্ত যায়, আবার ও পাশের ট্রেন থেকে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসতে থাকে উলটো দিকের ট্রেন বরাবর। এভাবে যতক্ষণ পর্যন্ত না দুটি ট্রেন একটা আরেকটার সাথে ধাক্কা খাচ্ছে ততক্ষণ মাছিটি এরকম করতেই থাকে। প্রথম ট্রেনটির বেগ ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটার আর দ্বিতীয় ট্রেনটির বেগ ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার। মাছিটির বেগ ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার। ট্রেন দুটি ধাক্কা খাওয়ার আগ পর্যন্ত মাছিটি মোট কত দূরত্ব অতিক্রম করবে?”
তিন চার সেকেন্ড সময় নিয়ে ভাবলেন ভন বাবু, এরপর চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, “১৫০ কিলোমিটার”
বেশ নিরাশ হলেন সেই অখ্যাত, অজ্ঞাত গণিতবিদ। “আপনি দেখি শর্ট-কাট রাস্তাটা জানেন মশাই, আমি তো ভাবলাম সবার মত আপনিও বুঝি ইনফাইনাইট সিরিজ যোগ করতে বসে পড়বেন।”
ভাপা পিঠার টুকরোটি মুখে দিতে গিয়ে থেমে গেলেন ভন, ভ্রু কুঁচকে বললনে, “কেন, আমি তো সেভাবেই করলাম।”

এডিংটনের দম্ভ

স্যার আর্থার এডিংটন ছিলেন এক বিশাল বড় নাকের মানুষ। সে কি যে সে বড় নাক, পুরো আইফেল টাওয়ারের সমান লম্বা। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের বাস্তবিক প্রমাণ উপস্থাপন করেছিলেন তিনি, এরপর তো তাঁর পা আর মাটিতেই পড়ে না। দুনিয়ার সবাই তখন তাঁর সামনে কুর্নিশ করে, তাঁর সামনে জ্বি হুজুর জ্বি হুজুর করে, ভয়ে থড়থড় করে কাঁপে।
আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রকাশ হবার পর থেকেই অনেক বিজ্ঞানী নাক সিঁটকে বেড়াচ্ছিলেন। তবে এডিংটন সেটাকে বুঝতে পেরেছিলেন ভালমতই। তো এক কনফারেন্সে এডিংটনের সাথে আপেক্ষিকতাবিরোধীদের বিবাদ চলছে, একের পর এক তুখোড় বিজ্ঞানী তাঁকে প্রশ্ন করছেন, আর এডিংটন নিজেকে ডিফেন্ড করে চলেছেন। সেই কনফারেন্সে উপস্থিত ছিলেন লুডউইগ সিলবারস্টাইন। নিজেকে আপেক্ষিকতাবিশারদ মনে করতেন তিনি। এডিংটনের পক্ষে দাঁড়ালেন তিনি। বলে বসলেন, “আপনার ভুলে যাচ্ছেন, এডিংটন বাবু সেই তিনজন বিজ্ঞানীর একজন যাঁরা আসলেই আপেক্ষিকতা তত্ত্বটি বোঝেন।”
এডিংটন বললেন, “না, মি. সিলবারস্টাইন, ব্যাপারটা আসলে সেরকম নয়”
-“না না, এডিংটন বাবু, এ তো আপনার বদান্যতা। আপনি তো সাক্ষাত বিনয়াবতার। কিন্তু আমি আসলে ঠিক কথাই বলছি।“
চশমাটা নাকের উপর তুলে নিয়ে এডিংটন বললেন, “আপনার বুঝতে ভুল হচ্ছে সিলবারস্টাইন সাহেব। আমি আসলে ভাবছিলাম, তৃতীয় ব্যক্তিটি কে?”

“…সুতরাং, ঈশ্বর আছেন [QED]”- অয়লার

রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী ক্যাথেরিন দ্য গ্রেট বিখ্যাত ফরাসী দার্শনিক ডেনিস ডিডেরটকে দাওয়াত দিয়েছেন। সম্রাজ্ঞীর দাওয়াত তো আর প্রত্যাখ্যান করা যায় না, ডেনিস বাবু গেলেন রাশিয়ায়। কিন্তু শুধুই কি যাওয়া, কম তো নয় তাঁর ছল-কলা। ছিলেন তিনি নাস্তিক। সম্রাজ্ঞীর মন্ত্রিসভায় এই নাস্তিক্যবাদ ছড়িয়ে দিতে লাগলেন তিনি। এদিকে রাজসভায় সবাই নাস্তিক হয়ে গেলে জাতি তো উচ্ছন্নে যাবে- এই ভাবনায় ক্যাথেরিন ম্যাডামের ঘুম হারাম। আবার নিজে আগ বাড়িয়ে ডেকে এনেছেন দার্শনিককে, ঝেটিয়ে তো আর বিদায় করতে পারেন না। সে সময় অয়লার ছিলেন সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সম্রজ্ঞী তাঁর ধর্ম-সংকটের কথা জানালেন অয়লারকে। খোঁজ-খবর নিয়ে অয়লার জানলেন, ডেনিস বাবু তো গণিতে ক লিখতে কলম ভাঙেন। ব্যস, আর পায় কে? ডেনিস বাবুকে বার্তা পাঠানো হল- এক গণিতবিদ ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন। ডেনিস বাবু সেই প্রমাণটি দেখবার ব্যাপারে উৎসাহ প্রকাশ করলেন।
পরদিন রাজসভায় সেই গণিতবিদকে (অয়লার) তলব করা হল। ডেনিস বললেন,
“কি হে গণিতবিদ, শুনেছি তুমি নাকি প্রমাণ করেছ ঈশ্বর আছেন”
-“আপনি ঠিকই শুনেছেন মহাশয়”
-“তা বল দেখি, কীভাবে প্রমাণ করলে?”
-“(a + b^n)/n = x…সুতরাং ঈশ্বর আছেন [QED]”
অয়লারের কথা শুনে ভিমড়ি খাওয়ার অবস্থা ডেনিস বাবুর। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ তিনি। ওদিকে পুরো রাজসভায় হাসির রোল পড়ে গেছে।
এ অপমান সহ্য হল না ডেনিস বাবুর। পরদিনই রাশিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তিনি।

কবে মরিব আমি, শুনিয়া রাখ, হে মোর বন্ধুবর
সাল ১৭৫৪, দিন ২৭ নভেম্বর”

গণিতবিদ আব্রাহাম ডি মোয়েভার, যাঁর নামে রয়েছে জটিল সংখ্যার সবচেয়ে সুন্দর সূত্রগুলোর একটি- ডি মোয়েভারের সূত্র। এই গণিতবিদ ছিলেন এক কর্মপাগল লোক। গণিত নিয়ে বসলে তাঁর খাওয়া ঘুমের হিসেব থাকত না। কিন্তু শরীর তো তার নিজের নিয়মেই চলবে। বয়স বাড়তে লাগল, আর ক্লান্ত হয়ে পড়তে লাগলেন মোয়েভার। একদিন খেয়াল করলেন, তিনি প্রতি দিন আগের দিনের চেয়ে ১৫ মিনিট বেশি ঘুমাচ্ছেন। বুঝতে পারলেন, এবার আর শরীরকে পোষ মানাতে পারবেন না। এই মারণ ঘুম তাঁর জীবন কেড়ে নেবে। নিজের মৃত্যু আসন্ন জানলে কার না খারাপ লাগে? মন হালকা করতে মোয়েভার গেলেন গীর্জায়। সেখানে এক কোনায় চুপটি করে বসে রইলেন অনেক ক্ষণ।
গীর্জার পাদ্রি ছিলেন মোয়েভারের পুরোনো বন্ধু। বন্ধুকে বিষণ্ণ দেখে এগিয়ে গেলেন তিনি।
-“কী খবর বন্ধু, এত মন খারাপ করে বসে আছ কেন?
-“মন তো একটু খারাপ হবেই বল, নিজের মৃত্যুর কথা জানলে তো হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠবেই”
-“কী বলছ এসব? গণিত নিয়ে এত যে পড়ে থাক, তাতেই পাগল হয়েছ মনে হচ্ছে। কার কখন মরণ হবে সেটা স্রষ্টা ছাড়া কেউ বলতে পারেন না”
-“আমি নিজের মৃত্যুদিন জেনে গেছি বন্ধু, আমি এখন ঠিক ঠিক বলে দিতে পারব আমি কবে মারা যাব”
-“বোকার মত কথা বলো না তো”
উঠে দাঁড়ালেন ডি মোয়েভার, একটু হেসে বললেন,
“কবে মরিব আমি, শুনিয়া রাখ, হে মোর বন্ধুবর
সাল ১৭৫৪, দিন ২৭ নভেম্বর”

ঠিক সেই দিনটিতেই মারা গিয়েছিলেন এই মহান গণিতবিদ
Credit: Ganitpathsala