PK

হোমিওপ্যাথির চালাকি

 হোমিওপ্যাথির চালাকি




১৭ শতকের শেষ দিকের “চিকিৎসাবিজ্ঞান” বলতে যা প্রচলিত ছিল সেটাকে “চিকিৎসা” বা “বিজ্ঞান” কোনোটাই বলা যায় না। তখনকার সেরা চিকিৎসা ছিল রক্ত কমানো (blood letting), purging, আর জোঁক দিয়ে রক্ত চোষানো (leeching)। ধারণা করা হতো মানুষের শরীরে চার ধরণের মৌলিক humour আছেঃ blood, phlegm, black bile, আর yellow bile। এদের সাম্যাবস্থা নষ্ট হওয়ার কারণে মানুষ অসুস্থ হয় বলে মনে করা হতো।


স্যামুয়েল হানেম্যান নামের এক জার্মান ডাক্তার বুঝতে পারলেন এই চিকিৎসা কখনোই “চিকিৎসা” হতে পারে না, কারণ এটি সমস্যা সমাধানের চেয়ে বেশী সমস্যা সৃষ্টি করে। ১৮০৭ সালে তিনি একটি তত্ত্ব নিয়ে হাজির হন, যার নাম হোমিওপ্যাথি। 




হোমিওপ্যাথির উদ্ভাবনের জন্য কয়েকটা বিষয় তাঁর মাথায় রাখতে হয়েছিল।

আর অনেক ক্ষেত্রে তিনি তাঁর কল্পনাকে পূর্ণ স্বাধীনতা আর চালাকির সুযোগ রেখে দিয়েছিলেন।




চালাকি ১:


হানেম্যান বলেন যে শরীরে যে দ্রব্যের কারণে রোগ সৃষ্টি হয় সেই দ্রব্য দিয়েই সে রোগের চিকিৎসা সম্ভব। যেমন- এলার্জির জন্য দায়ী দ্রব্য দিয়ে শরীরের humour এর মাত্রাকে প্রভাবিত করে এলার্জিরই চিকিৎসা সম্ভব। এর নাম তিনি দেন “similia similibus curentur” বা the law of similar।

তবে, সন্দেহবাদিরা প্রশ্ন তুলতে লাগলেন আসলেও হানেম্যানের চিকিৎসা “চিকিৎসা” কী না সেটা নিয়ে। রোগের জন্য দায়ী দ্রব্য দিয়ে আবার সেই রোগের চিকিৎসা হয় নাকি? প্রশ্নটা যৌক্তিক।




চালাকি ২:


হানেম্যানও জানতেন এটা, তাই তিনি উদ্ভাবন করেন law of infinitesimal। যেখানে তিনি বলেন দ্রব্যটাকে যদি অ্যালকোহল বা জলে দ্রবীভূত করা হয় তবে তার রোগসৃষ্টির ক্ষমতা কমে যায়, আর শরীর সেটাকে গ্রহণ করে নিজের চিকিৎসা নিজেই করে। তর্কের খাতিরে কথাটা হয়তো মেনে নেয়া যেত, কারণ শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা মারাত্মক রকমের হয়। তবে হানেম্যান বললেন- যে ওষুধ যত বেশী লঘুকৃত (diluted) তার ক্ষমতা তত বেশী। হ্যাইনম্যানের ওষুধগুলো সাধারণত ১০^৩০ ভাগের ১ ভাগ ওষুধ থাকে আর বাকি সব দ্রাবক। অন্যভাবে বলতে গেলে পৃথিবীর সকল মরুভূমি আর সমুদ্রসৈকতের সকল বালুকণার মাঝে ১টি বালুকণা হচ্ছে ওষুধের দ্রব্য, বাকিগুলো দ্রাবক!




চালাকি ৩:


স্যামুয়েল হানেম্যান খুব চালাকি করে তিনি একটি শব্দ উদ্ভাবন করেন- অ্যালোপ্যাথি। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সকল সফলতা, প্রমাণলব্ধ সকল ওষুধ, কার্যকরী সকল থেরাপী, internal medicine, oncology, neurology, cardiology, psychiatry, pathology, surgery, infectious disease, hematology, geriatrics, gastroenterology, ophthalmology, radiology, orthopedics, nephrology, urology, pharmacology, emergency medicine and critical care সব কিছু অ্যালোপ্যাথি, এক শব্দে প্রকাশিত। সুতরাং হোমিওপ্যাথি যেমন ওষুধ অ্যালোপ্যাথিও তেমনি! ২০০ বছর আগে একজনের বলা চিকিৎসা ব্যবস্থা আর তখন থেকে হাজার হাজার গবেষকের হাজার হাজার ঘণ্টার গবেষণার ফলাফল একই সমান বলে বিবেচনা করা বোকামি ছাড়া আর কিছু না। নতুন ফলাফলের সাথে জ্ঞানের পরিবর্তন আধুনিক বিজ্ঞানের মূল ভিত্তি, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানও।



এরপরও মানুষ বোকা বনছে, কারণ তাদের সামনে হোমিওপ্যাথিকে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সমান করে উপস্থাপন করা হয়েছে, ওদের সামনে দুইটা পথ তুলে ধরা হয়েছে, যদিও হোমিওপ্যাথির পথটা কোনো পথই না। খোদ ব্রিটেনের রাজ পরিবারে একজন নির্দিষ্ট হোমিওপ্যাথিক “ডাক্তার” আছেন।




অ্যাভোগেড্রোর সংখ্যা আর হোমিওপ্যাথিক চালাকি:




রাসায়নিক পদার্থের পারমাণবিক ভর অথবা আণবিক ভরকে গ্রামে এককে প্রকাশ করলে যে পরিমাণ পাওয়া যায় তাকে সেই পদার্থের এক মোল। কোন রাসায়নিক পদার্থের যে পরিমাণে ৬.০২২১৪১৫ X ১০^২৩ টি অণু, পরমাণু বা আয়ন থাকে তাকে সে পদার্থের মোল বলে। যেমন এক মোল কার্বন হচ্ছে ১২ গ্রাম, মানে ১২ গ্রাম কার্বনে সাধারণত ৬.০২ X ১০^২৩টি কার্বন অণু থাকে। সংখ্যাটিকে ভেঙ্গে লিখলে হয়- ৬০২,২১৪,১৫০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০। আরেক ভাবে হিসাব করলে সংখ্যাটি যে কত বড় সেটা বুঝতে পারবেন। আপনি যদি ১,০০০টি অফসেট কাগজ নিয়ে বাণ্ডিল করে রাখেন তবে সেটার উচ্চতা হবে প্রায় ৫ ইঞ্চি। আপনি যদি ৬০২,২১৪,১৫০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০টি কাগজের বাণ্ডিল বানান, সেটার উচ্চতা হবে পৃথিবী থেকে সূর্যের দুরত্ব, যা হচ্ছে ৯৮ মিলিয়ন মাইল; সেই দুরত্বকে ৪০০,০০০,০০০বার অতিক্রম করার মত উঁচু।

সাধারণ হোমিওপ্যাথির ওষুধ 6X থেকে 30X পর্যন্ত মিশ্রিত (diluted) থাকে। এখানে X বলতে রোমান ১০ বুঝানো হয়ে থাকে, যার মানে দাঁড়ায় ১০^৬ বা এক মিলিয়নে এক ভাগ রোগ নিয়ামক মিশানো হয়েছে, আর ১০^৩০ এর মানে দাঁড়ায় যে ১০ এর পরে ত্রিশটি শূন্য দিলে যে সংখ্যা পাওয়া যায় সে সংখ্যার এক ভাগ রোগ নিয়ামক মিশানো হয়েছে। বাজারে C স্কেলের হোমিওপ্যাথিক ওষুধও পাওয়া যায়, রোমান C দিয়ে ১০০ বুঝানো হয়। তার মানে ৩০C ওষুধে ১০০^৩০ভাগের এক ভাগ রোগ নিয়ামক থাকে। খুব শক্তিশালী হওয়ার কথা, না?

তো, অ্যাভোগেড্রোর সংখ্যা বের হওয়ার পর দেখা গেলো হানেম্যানের বেশীর ভাগ ওষুধ এই সীমার বাইরে অবস্থান করছে, আর রসায়নের এই সূত্র অনুযায়ী- এই ওষুধগুলোকে শুধু জল (বা অ্যালকোহল) বলা যায়, নিশ্চিন্তভাবেই বলা যায়। মানে হোমিওপ্যাথির ওষুধ কোনো ওষুধই না, বরং জল বা অ্যালকোহল। বড়ি আকারে প্রাপ্ত হোমিওপ্যাথির ওষুধগুলো শুধু চিনির গোলা।


হানেম্যান কী দমে গেলেন তাতে? নাহ! তিনি বললেন- জলকে যদি ঠিকমত উত্তেজিত করা যায়, নাড়ানোর মাধ্যমে- তবে জলর অণুগুলোর স্মৃতিতে ওষুধের দ্রব্যের একটা ছাপ থেকে যায়, আর সেটাই রোগ নিরাময় করে। উত্তেজিত জল কিছুই ভুলে না! এই ব্যাপারটা নাকি আধ্যাত্মিক। জলরও নাকি আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আছে।




ভ্যাকসিন আর হোমিওপ্যাথিক চালাকি:


প্রায়ই হোমিওপ্যাথরা বলে থাকে হোমিওপ্যাথি অনেকটা টিকার মতো কাজ করে। আর আপাতদৃষ্টিতে সেটা মনে হতেও পারে। রোগের কারণের দ্রব্য শরীরে স্বল্প পরিমাণে দিয়ে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে চাঙ্গা করে রোগের প্রতিষেধক বের করা, টিকা মূলত এভাবেই কাজ করে। তবে টিকার সাথে হোমিওপ্যাথির পার্থক্য হচ্ছে টিকা দেওয়া হয় এমন রোগের জন্য যা শরীরে অনুপস্থিত, আর হোমিওপ্যাথি শরীরে উপস্থিত রোগের “চিকিৎসার” জন্য দেয়া হয়, যে রোগের জন্য প্রতিরোধ শরীরে ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।

টিকা হিসেবে ব্যবহৃত দ্রব্যে রোগের কারণ থাকে নিদির্ষ্ট পরিমাণে, আর হোমিওপ্যাথির ওষুধে- যেমনটা আমরা উপরে দেখলাম- কিছুই থাকে না। টিকা দেওয়ার ফলে শরীরে যে পরিমাণ প্রতিষেধক উৎপন্ন হয় সেটা রক্তপ্রবাহে নির্নয় করা যায়, হোমিওপ্যাথি- যেমনটা বুঝতেই পারছেন, যায় না।

“হোমিওপ্যাথি আসলেও কী কাজ করে” এবং আরো একটি চালাকি

হোমিওপ্যাথির কার্যকারিতা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাঙ্খিত ফলাফলই এসেছে- যে হোমিওপ্যাথি কাজ করে না- আর যেসব ক্ষেত্রে কাজ করে সেগুলোকে প্লাসিবো ইফেক্ট বলে ধরে নেয়া যায়। তবে কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে হোমিওপ্যাথির কার্যকারিতা প্লাসিবোর চেয়েও বেশী। তবে সে সব গবেষণা নিয়ে প্রশ্ন আছে। National Institutes of Health এর মতে- “পরীক্ষণগুলোর ডিজাইনে দূর্বলতা ছিল, রিপোর্টিংয়েও। পরিমাপের একক নির্ধারণে সমস্যা ছিল, অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা অপ্রতুল ছিল, আর একই ফলাফল বারবার পাওয়া যাচ্ছিল না।”

British Medical Journal এর ১৯৯১ সালে প্রকাশিত ২৫ বছর ধরে করা গবেষণায় ১০৭টি কনট্রোল পরীক্ষণের হোমিওপ্যাথির পক্ষে ফলাফল পাওয়া যায়। হোমিওপ্যাথরা এই ব্যাপারটিকে অনেক বড় করে প্রচার করেন। তবে একই গবেষণার উপসংহারে বলা হয়েছে “At the moment the evidence of clinical trials is positive but not sufficient to draw definitive conclusions because most of the trials are of low methodological quality and because of the unknown role of publication bias.” অর্থাৎ, সেই সময়ে প্রাপ্ত গবেষণার ফলাফল থেকে এই উপসংহারে যাওয়া যায় না যে হোমিওপ্যাথি কার্যকর, পরীক্ষণগুলো নিম্নমানের জন্য। “Publication bias” বলতে বুঝানো হয়েছে যে অসমাপ্ত গবেষণার ফলাফলকে হোমিওপ্যাথরা প্রকাশ করে নিজেদের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করছেন। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল আরো জানায় যে- এ থেকে ভবিষ্যৎ গবেষণার তাগিদ পাওয়া যায়, আর আরো উন্নত মানের পরীক্ষণের মাধ্যমে ফলাফল বের করা সম্ভব।

তবে ব্রিটিশ হোমিওপ্যাথরা সোজা বলে দিয়েছে- নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষণ দিয়ে হোমিওপ্যাথির কার্যকারিতা গবেষণা করা সম্ভব না। মানে এটা পরীক্ষার উর্ধ্বে। মানে হোমিওপ্যাথিকে প্রশ্ন করা যাবে না। হোমিওপ্যাথিকে প্রশ্ন করা নিষিদ্ধ ব্যাপার। কোনো কিছুর সাথে মিল পাচ্ছেন?




জেমস র‍্যান্ডি আর হোমিওপ্যাথি:


পেশাজীবী সন্দেহবাদি জেমস র‍্যান্ডি প্রায়ই তার পাবলিক বক্তব্যের আগে ওষুধ খেতেন। পরে তিনি জানাতেন এই মাত্র তিনি হোমিওপ্যাথিক ঘুমের বড়ির ৬ মাসের কোর্স একবারে গিলে ফেললেন। বক্তব্যের শেষে তিনি দিব্যি হেঁটে বেরিয়ে গেলেন, ঘুমালেন না! আরেকবার তিনি কংগ্রেসে গেলেন একই ওষুধ খেয়ে, কাজ হলো না- র‍্যান্ডি ব্যঙ্গাত্মকভাবে জানান- “কংগ্রেসের মিটিং আর হোমিওপ্যাথির ঘুমের ওষুধ মিলেও আমাকে ঘুম পাড়াতে পারলো না…আমার মনে হয় কিছুই আমাকে ঘুম পাড়াতে পারবে না।”

জেমস র‍্যান্ডির একটা চ্যালেঞ্জ ছিল- অতিপ্রাকৃত প্রমাণে ১ মিলিয়ন ডলার পুরষ্কার। সেটাতে তিনি হোমিওপ্যাথিকেও সুযোগ দিয়েছিলেন অংশ নেয়ার। কয়েকজন হোমিওপ্যাথ অংশ নিলেও তাদের বিদ্যার কার্যকারিতা প্রমাণ করতে পারেননি। আর বড় বড় হোমিওপ্যাথরা সেটাতে অংশই নেননি। ভেবে দেখুন তো, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সন্দেহবাদির কাছে গিয়ে নিজেদের ওষুধের প্রমাণ দেয়াটা কতবড় পাবলিসিটি হতে পারতো তাদের জন্য। তারপরও গেলেন না। কারণটা কী হতে পারে?




হোমিওপ্যাথিতে সমস্যা কী ?:


অনেকে হয়ত ভাবতে পারেন হোমিওপ্যাথিতে সমস্যা কী? কাউকে তো জোর করে ওষুধ খাওয়ানো হচ্ছে না, বা যদি সেটা কোনো ওষুধই না হয়ে থাকে তবে তার কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও তো নেই। সমস্যাটা নৈতিক। একজন অসুস্থ ব্যক্তিকে ওষুধের নামে জল/অ্যালকোহল বা চিনির বড়ি খাইয়ে টাকা নেয়া প্রতারণা। অনেক ক্ষেত্রে প্লাসিবো কাজ করে, অনেক ক্ষেত্রে করে না। যে ক্ষেত্রে করে না সে রোগীদের কষ্ট লাঘবের অন্য ব্যবস্থা থাকা স্বত্ত্বেও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা নেয়াটা নৈতিকভাবে ভুল। হোমিওপ্যাথি অপবিজ্ঞান, যে কোনো অপবিজ্ঞানেরই অনেক ভক্ত থাকেন, যারা খুব নিশ্চিত যে তাদের জানা জ্ঞানই ঠিক, বাকিদের সকল জ্ঞান-বিজ্ঞান-পরীক্ষা-গবেষণা ভুল।


এক শ্রেণীর মানুষ আছেন যারা মনে করেন প্রভাবশালী সকল দেশের রাষ্ট্রনায়কেরা রূপ-বদলাতে পারা গিরিগিটিদের প্রতিনিধি। তাদের সাথে কথা বলে বুঝানোর চেষ্টা করলে ওরা আপনাকে বলবে ব্রেইনওয়াশড- সিস্টেমের গোলাম। হোমিওপ্যাথির ক্ষেত্রেও প্রায় এমনটাই হয়। যারাই হোমিওপ্যাথিকে প্রশ্ন করবে তারাই হোমিওপ্যাথির উন্নতির বিপক্ষে বা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানীর টাকা খাওয়া লোক বলে দাবী করা হয়। প্রামাণ্যতা না, পক্ষ-বিপক্ষ বিবেচনা করে যদি ওষুধের কার্যকারিতা মাপতে হয় তবে সেটা কতটুকু ওষুধ তা ভাবার বিষয়। ওষুধের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে যদি সুফল লাভ করতে হয়, তবে কী চলে?