PK

GOLDEN RATIO

 রহস্যময়তা কিংবা প্রায়োগিক দিক অথবা প্রকৃতির মাঝে খুঁজতে চাইলে সবচেয়ে বেশি এবং প্রকটভাবে ধরা পরবে গোল্ডেন রেশিও; এবং বার বার আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে স্মরণ করিয়ে দিবে তার শ্রেষ্ঠত্ব। একারনেই সর্বাধিক গবেষণা হয়েছে এই সংখ্যাটিকে নিয়ে।


যাকে নিয়ে এতো গবেষণা সেই Golden Ratio টা আসলে কী? এটা আসলে আর কিছুই নয়, একটা গাণিতিক অনুপাত মাত্র যার মান 1.618033988……। হ্যা ব্যাপারটা নির্মম হলেও সত্য যে এই Golden Ratio অন্য

দুই বিখ্যাত সংখ্যার মতই দুষ্টু (অমূলদ সংখ্যা)।


তা এই দুষ্টু (অমূলদ ) সংখ্যার এত মাহাত্ম্য কিসে্র? আসলে এই সংখ্যাতেই লুকিয়ে আছে সৃষ্টিজগতের অনেক রহস্যের সমাধান , একটু গভীর ভাবে দৃষ্টি দিলেই আমরা একে খুঁজে পাব আমাদের দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে , গোটা জীব জগতে , পদার্থ কিংবা রসায়নে , পাব আমাদের সৌরজগতে , আমাদের গ্যালাক্সিতে ; খুঁজে পাব অ্যাপল ,মার্সিডিজ এর মত বিখ্যাত কোম্পানীর লোগোতে । এই সংখ্যাই আমাদের বলে দিবে কেন পিরামিড কিংবা তাজমহল এত মনোমুগ্ধকর ? কেন ভিঞ্চির মোনালিসা জগতখ্যাত ? কেন আমাদের বান্ধবীর চেয়ে ক্যাটরিনা কাইফ বেশি সুন্দরী ? কে বেশি আকর্ষণীয়, আঞ্জেলিনা জোলি নাকি অনন্ত জলিল ? কে বেশি ঠাণ্ডা (Cool), টম ক্রুজ নাকি শাকিব খান ? এ সব প্রশ্নেরই উত্তর মিলবে এই সংখ্যা থেকে । তাহলে আসুন প্রবেশ করি The Number of Life – The Golden Ratio এর জগতে……


Golden Ratio বা  সোনালী অনুপাতকে প্রকাশ করা হয় ল্যাটিন অক্ষর Φ (PHI/ ফাই ) দ্বারা। PHI ই বেশি ব্যবহৃত হয়। প্রথমে আমরা PHI এর গাণিতিক ব্যাখ্যা দিয়ে শুরু করি (হুম ,এখানেও গণিত; গণিতেই যে সবকিছুর শুরু)।


গণিতবিদ ইউক্লিড তার ‘এলিমেন্টাস’ গ্রন্থে প্রথম PHI এর জ্যামেতিক ব্যখ্যা দেন । তিনি কোন একটি সরলরেখার উপর এমন একটি বিন্দু কল্পনা করেন ( যাকে বলা হয় গোল্ডেন পয়েন্ট ) যাতে রেখাটি এরকম অনুপাতে বিভক্ত হয় যে, ছোট অংশ/বড় অংশ = বড় অংশ/সম্পূর্ণ অংশ । এবং সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে সবসময় উপরের এই অনুপাতের মান হবে 1.6180… : 1 (PHI:1) । এবং ইউক্লিড এই সম্পর্ক থেকে অনেকটা এভাবে PHI এর মান বের করেছিলেন :



অথবা উল্টো করে বললে এই অনুপাতকে আমরা 1 : 1.6180… = 0.6180… ও বলতে পারি । এই 0.6180… কেও কিন্তু গোল্ডেন রেশিও বলা হয় । এবং একে ছোট হাতের ফাই (φ) দ্বারা প্রকাশ করা হয় । তার মানে সম্পর্কটা হচ্ছে এরকম : Φ=1/ φ


PHI কে কিন্তু আরো অনেকভাবে প্রকাশ করা যায় ; দেখতো এটা পরিচিত মনে হয় কিনা :


Φ=1+1/(1+1/(1+…))


এই PHI ই হল একমাত্র সংখ্যা যা এই ধরনের অদ্ভুত আচরণ করে :


Φ   = √Φ + 1           [আবার √Φ = 1/ Φ= Φ -1 = 0.618 !!! ]


Φ 2 = Φ + 1


Φ 3 = Φ 2 + 1……


Φ n+2 = Φ n+1 + Φ n


PHI এর সাথে কিন্তু ফিবনোচ্চি সিরিজেরও গভীর সম্পর্ক রয়েছে । আচ্ছা ফিবনোচ্চি সিরিজটা কি ? এটা হল এমন একটা সিরিজ যার প্রতিটা পদ আগের দুই পদের যোগফল :


1,1,2,3,5,8,13,21,34,55,89,144…………


PHI এর মান আমরা ফিবনোচ্চি সিরিজ থেকেও পেতে পারি । আমরা যদি ফিবনোচ্চি সিরিজের যেকোন পদকে আগের পদ দিয়ে ভাগ করি তাহলে সেই সংখ্যাটাই PHI !! প্রথম কয়েকটা পদের জন্য হিসেব কিছুটা বিদঘুটে মনে হবে কিন্তু আমরা ফিবনোচ্চি সিরিজ ধরে যত সামনে যেতে থাকব তত ক্রমিক সংখ্যাদ্বয়ের অনুপাত PHI এর দিকে আগাবে ; এবং ৩৯ তম পদ থেকে ক্রমিক সংখ্যাদ্বয়ের অনুপাত প্রায় ধ্রুব হয়ে যাবে এবং সেই ধ্রুব সংখ্যাই PHI ।


এবার আসুন দেখি জ্যামেতিকভাবে কিভাবে ফিবনোচ্চি থেকে PHI তে আসা যায় । আমরা প্রথমে ফিবনোচ্চি ক্রম অনুযায়ী চিত্রের মত করে একটার পিঠে একটা করে বর্গক্ষেত্র আঁকি ( ১মে ১ বর্গএকক, তারপর আবার ১ বর্গএকক , তারপর ২ বর্গএকক , তারপর ৩ , তারপর ক্রমান্বয়ে ৫ , ৮, ১৩,২১,৩৪ বর্গএকক ) । এবং এভাবে আঁকতে থাকলে আমরা যেখানেই থামিনা কেন সবসময়ই তা একটি বিশেষ আয়তক্ষেত্র গঠন করবে , এ বিশেষ আয়তক্ষেত্রকে বলে Golden Rectangle ।বিশেষ কেন? কারণ প্রতিবারই আয়তের দৈর্ঘ্য:প্রস্থ = 1.6180…=Golden Ratio (PHI) । এবার যদি আমরা আয়তের কর্ণ গুলো একের পর এক যুক্ত করি ( চিত্রের মত ) তাহলে একটা spiral তৈরি হবে ; একে বলা Golden Spiral । এবং এ spiral এর বক্রতার সাথেও PHI এর সম্পর্ক রয়েছে ।



যারা ইতোমধ্যে গনিতের কপচানি দেখে বিরক্ত , তাদের আর বিরক্ত করব না । এবার সরাসরি ঢুকে পড়ি বাস্তব জগতে । দেখি PHI এর আসল চমক কোথায়? তবে এই Golden Rectangle ( সোনালী আয়ত ) এবং Golden Spiral এর ব্যাপারটা মনে রাখুন, সামনেই কাজে লাগবে ।


লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি – Golden Ratio এর মাস্টার বলা হয় যাকে তিনি একে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘The Divine Proportion’ বা ‘ স্বর্গীয় অনুপাত’ নামে । কারণ তিনিই প্রথম মানবদেহে PHI এর উপস্থিতি লক্ষ করেন ; বুঝতে পারেন এর মর্ম ( তিনি মৃত মানুষের দেহের বহিঃস্থ ও ভিতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে অনেক গবেষণা করতেন ; ময়নাতদন্ত যাকে বলে আর কি । আমরা ডাক্তারের চেম্বারে যেসব মানুষের অঙ্গের ছবি দেখি সেগুলো প্রথম ভিঞ্চিই ডিজাইন করেছিলেন )।


মানব দেহে PHI ? সেটা আবার কি রকম ? যেমন ধরুন ছেলে/মেয়ে সকল বয়সের মানুষের ক্ষেত্রেই , দেহের সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য : নাভির নিচ থেকে বাকি অংশের দৈর্ঘ্য = 1.6180…(PHI) ; আবার কাঁধ থেকে হাটু পর্যন্ত এবং হাটু থেকে পায়ের আঙ্গুলের মাথা পর্যন্ত দূরত্বের অনুপাত ও 1.6180…(PHI) ; মানুষের বাহু(বাইসেপ্স) এর সাথে সম্পূর্ণ হাত এর অনুপাতের মান হল 1.6180…(PHI); মানুষের আঙ্গুলের অগ্রভাগ থেকে কনুই এর দৈর্ঘ্য এবং কবজি থেকে কনুই এর দৈর্ঘ্যের অনুপাত 1.6180…(PHI) ; মানুষের মুখমণ্ডলের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত 1.6180…(PHI) ; ঠোঁটের দৈর্ঘ্য ও নাকের প্রস্থের অনুপাত , চোখের ২ প্রান্তের দুরুত্ব ও চুল থেকে চোখের মনির দুরুত্ব ও 1.6180…(PHI) ।সারা মুখমন্ডলের সবকিছুতে , শরীরের গিঁটে গিঁটে , মেরুদন্ডে , অভ্যন্তরের অঙ্গেপ্রত্যঙ্গে সবখানে এই PHI খুঁজে পাওয়া যাবে । গোটা মানবদেহে প্রায় ৩ শতাধিক Golden Ratio (PHI) খুঁজে পাওয়া যায় ; মুখমণ্ডলেই পাওয়া যায় ৩০ টিরও বেশি । এইযে দেখুন , মানুষের চেহারায় কিভাবে Golden Rectangle এবং Golden Spiral পুরো খাপে খাপে বসে যায় ।



কিন্তু এখানে একটা ‘কিন্তু’ আছে ; সেই ‘কিন্তু’র উপরেই আমাদের সৌন্দর্য নির্ভর করে । সেই ‘কিন্তু’ নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করব (করবই ) । এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই ।


এদিকে আমাদের লিওনার্দো ভিঞ্চি সাহেব কিন্তু শুধু মানুষের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট নিয়েই বসে ছিলেন না । তিনি নির্দ্বিধায় (অথবা অবচেতন মনে ) সমানে প্রয়োগ করতে লাগলেন এই Golden Ratio (PHI) । কোথায় ? তার শিল্পকর্মে । তার বেশির ভাগ শিল্পকর্মতেই PHI খুঁজে পাওয়া যায় ; The last Supper , Merry Magdalin , Monalisa সবগুলোই PHI এর কারিশমা । এবং এজন্যই এগুলো জগতখ্যাত , মানুষের মন জয় করে নিয়েছে । নিচের চিত্রে Monalisa – তে কিভাবে PHI প্রয়োগ হয়েছে তা দেখানো হল ; Golden Rectangle অথবা Golden Spiral পুরোই খাপে খাপে বসে যায় এতে । (তারপরও একটা জিনিস কিন্তু Monalisa’র নাই !!! ভ্রু নাই … এছাড়াও Monalisa ‘র ছবির আরো অনেক রহস্যময় দিক আছে ) । এছাড়া বিখ্যাত অনেক শিল্পীরাই তাদের কাজে PHI প্রয়োগ করেছেন । সেরকম একটি ছবি :




শুধু মানবদেহই নয় , গোটা প্রানীকুলে-উদ্ভিদকুলে সব কিছুতেই মাত্রাগত ভাবে PHI বিদ্যমান । সকল উদ্ভিদ – প্রানীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গও PHI অনুপাতে বিভক্ত । এমনকি যে প্রানীর কোন হাত-পা-মাথা কিছুই নেই , যেমন শামুক-ঝিনুক-সী-শেল এসবেও কোন-না-কোনভাবে PHI রয়েছে  !! [ নিচের চিত্র দ্রষ্টব্য ]



তারপর ধরুন একটা মৌচাকে স্ত্রী মৌমাছি ও পুরুষ মৌমাছির সংখ্যার অনুপাত PHI । ফুলের ভেতর প্রতি স্তরের রেনুর সাথে পরের স্তরের রেনুর অনুপাত PHI । গাছের প্রতি স্তরে স্তরে পাতা বৃদ্ধির অনুপাত PHI । তারপর ধরুন মৌমাছি সহ আরো অনেক ধরণের মাছি ,কীট, ওয়াইল্ড ডগ ইত্যাদির চলাফেরার পথ কিংবা আক্রমনের পথ হয় Golden Spiral অনুযায়ী (মানে PHI )। আমাদের DNA তেও আমরা যদি বৃহৎ খাঁজ(Major Groove) ও ক্ষুদ্র খাঁজের (Minor Groove ) অনুপাত নেই সেটাও হবে PHI । এমনকি দেখুন মুরগীর ডিমেও কি করে Golden Spiral খাপে খাপে বসে যায়!



পদার্থবিজ্ঞানের চৌম্বকক্ষেত্র কিংবা বিদ্যুৎক্ষেত্রে ,সরল ছন্দিত স্পন্দনে , তাপবিজ্ঞানে সবখানেই পাওয়া যায় PHI । কোয়ান্টাম মেকানিক্স থেকে আমরা যদি ইলেকট্রন কিংবা প্রোটনের g-factor ব্যখ্যা করতে চাই , সেখানেও PHI : g-factor of electron = -2/sin(PHI)।


আমরা যদি পোলারাইজড হাইড্রোজেন বন্ড ও সাধারন হাইড্রোজেন বন্ডের অনুপাত নেই সেটাও হবে PHI।


এবার আমরা দেখি আর্কিটেকচারে কিভাবে PHI এসেছে । মিসরের পিরামিডে , আগ্রার তাজমহলে , ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ারে , নটরডেমে, পারথেননে , ইউনাইটেড নেশন বিল্ডিং সহ আরও অজস্র স্থাপত্যে PHI ব্যবহৃত হয়েছে।PHI থাকার কারণেই এগুলো এত বেশি দৃষ্টিনন্দন । নিচে কয়েকটি নমুনাঃ







সঙ্গীতের নোটের ক্ষেত্রেওও PHI বিদ্যমান । ভায়োলিনসহ আরো অনেক বাদ্যযন্ত্র বানানো হয়েছে PHI দিয়ে।


এবার দেখা যাক কিছু বিখ্যাত কোম্পানির লোগোতে কি করে PHI ব্যবহৃত হয়েছে । [নিচের চিত্র দ্রষ্টব্য ]

















হারিকেন ,ঘূর্ণিঝড় , ধোঁয়ার কুণ্ডলী সবসময়ই Golden Spiral অনুসরন করে বৃদ্ধি পায়। এমনকি  গ্যালাক্সি গুলোও Golden Spiral অনুসরন করে বিস্তৃত হয় । [চিত্র : গ্যালাক্সি ও হ্যারিকেন ]




আমাদের সৌরজগতের গ্রহগুলোর সূর্যের চারপাশে আবর্তনকালও PHI এর সাথে সম্পর্কিত । তারা পৃথিবীর আবর্তনকালের সাথে PHI এর সুচক আকারে পরিবর্তিত হয় । নিচে পৃথিবীর আবর্তনকে ১ ধরে কয়েকটির আবর্তনকাল দেয়া হল (পৃথিবীর তুলনায় কত গুন )

Mercury Venus Earth Jupiter Saturn
Power of Phi-3-1057
Decimal Result0.240.621.011.129.0
Actual Period0.240.621.011.929.5

শনি গ্রহের বলয়ের ক্ষেত্রেও বাহিরের উজ্জ্বল বলয় ও ভেতরের অন্ধকার বলয় এর অনুপাত PHI ।

এছাড়াও আমাদের পৃথিবী ও চাঁদ কে সাথে নিয়ে নিচের মত ত্রিভুজ গঠন করলে তা PHI (Ø) এর সাথে sin অনুপাতে থাকে ( নিচের চিত্রের মত )


PHI এসেছে বাইবেল এও (আর্ক অফ কনভেন্টের বর্ণনায় ) । আমরা যদি উত্তর মেরু ও দক্ষিন মেরু থেকে মক্কার কাবা’র দুরুত্ব নেই , তবে তাদের অনুপাতও হবে PHI (না , আমি এর মাধ্যমে কিছু প্রমাণ করার চেষ্টা করছি না ; আমি বিশ্বাস করি এটা কাকতালীয় ঘটনা মাত্র)।

এরকম আরো অসংখ্য PHI খুঁজে পাওয়া গিয়েছে সৌরজগতে , মহাবিশ্বে , আমাদের পৃথিবীর আনাচে কানাচে । মহাবিশ্বের চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যেও PHI (Golden Ratio) বজায় রেখেছে তার শৃঙ্খলা । সবকিছুর ভেতরে এক অপার মেলবন্ধন সৃষ্টি করেছে । সবকিছুতেই একটু গভীর দৃষ্টি দিলেই PHI খুঁজে পাওয়া যাবে। এজন্যই একে বলা হয় The number of life , The divine proportion ( স্বর্গীয় অনুপাত ) ।

এই PHI তেই লুকিয়ে আছে সবকিছুর সৌন্দর্য । মানুষের সৌন্দর্যও নির্ভর করে এর উপর । কিভাবে? সব মানুষেই তো PHI আছে ; তাহলে সবাই সমান সুন্দর নয় কেন ? সমান আকর্ষণীয় নয় কেন ?