PK

পোকা আবিষ্কার

 পোকা আবিষ্কার


কাহিনীর শুরু ১৯শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৭।

কুয়েতের আল-আহমেদি তেল শোধনাগার থেকে এক বিশাল তেলবাহী জাহাজ অশোধিত তেল নিয়ে রওনা হলো ওয়েলস অভিমুখে। সেই আমলে ওটাই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো সুপার-ট্যাঙ্কার, টোরি ক্যানিয়ন। তার গর্ভে সেদিন প্রায় এক লক্ষ আঠারো হাজার লিটার তেল।


ঠিক একমাস পর ১৮ মার্চ, সকাল সাড়ে নয়টা নাগাদ পর্যটকদের প্রিয় কর্নিশ উপকূল ধরে এগোনোর সময় ঘটলো এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা। আটলান্টিক সমুদ্রের তলায় থাকা ডুবোপাহাড়ের সাথে ধাক্কা লেগে ফেঁসে গেল টোরি ক্যানিয়নের তলদেশ। আঠেরোটি ট্যাঙ্কের মধ্যে চোদ্দোটি ট্যাঙ্ক ফুটো হয়ে

গল গল করে বেরিয়ে আসতে লাগল তেল। কয়েকদিনের মধ্যে প্রায় ৬০ হাজার লিটার তেল ছড়িয়ে পড়ল কর্নিশ উপকূলে। সমুদ্রের প্রায় এক হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল দশ ইঞ্চি পুরু তেলের স্তর। ব্রিটেন তো বটেই, প্রমাদ গুণল সারা দুনিয়া। এত বড়ো তেল বিপর্যয় আগে কখনও দেখেনি মানুষ।


জলে ভাসমান তেল নষ্ট করতে তখন বিজ্ঞানীদের হাতে ছিল একটাই প্রযুক্তি – ডিটারজেন্টের ব্যবহার। নৌসেনা বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে প্রায় দশ হাজার টন ডিটারজেন্ট ছড়ানো হল সমুদ্রে ভাসমান তেলের ওপর। কিন্তু তাতেও কি সব তেল নষ্ট করা যায়? নিরুপায় বৃটিশ প্রশাসন ট্যাঙ্কারের অবশিষ্ট তেল পুড়িয়ে শেষ করার জন্য বিমান বাহিনীর সাহায্যে টোরি ক্যানিয়নের ওপর শক্তিশালী বোমা নিক্ষেপ করল। ভয়ানক বিষ্ফোরণ হলেও আগুন বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না সমুদ্রের জোরালো ঢেউয়ের জন্য। ফলে ধ্বংস হওয়া ট্যাঙ্ক থেকে আরও তেল বেরিয়ে এল। ১৯০ কিলোমিটার কর্নিশ উপকূল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল। এক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় পনেরো হাজার সামুদ্রিক পাখি মারা গেল। সংখ্যাটা পরে প্রায় ৪০ হাজারে পৌঁছোয়। ভীষন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র।


এমন বিপর্যয় তো ঘটতে পারে আবারও। তখন কী হবে! বিশ্বের তাবড় তাবড় শিল্পসংস্থা গুলো এই বিপদ থেকে উদ্ধারের পথ খুঁজতে বিজ্ঞানীদের দ্বারস্থ হলেন। ওই সময় বিজ্ঞানীদের কাছে কয়েকটি ব্যাকটেরিয়ার কথা জানা ছিল যেগুলি তেলের হাইড্রোকার্বনকে ভক্ষণ করতে সক্ষম। এদের তৈলখাদক বা সোজা বাংলাতে তেলখোর ব্যাকটেরিয়া (Oil eating Bacteria) বলে। তবে এককভাবে একটি ব্যাকটেরিয়ার ক্ষমতা অনেক কম। আবার তেলখোর ব্যাকটেরিয়ার বিভিন্ন স্ট্রেন একসাথে থাকলে তারা পরস্পর প্রতিযোগিতা করে তেল ভক্ষণের হার আরও কমিয়ে দেয়।


তরুণ এক বাঙালি বিজ্ঞানী সেই সময় ঐ ব্যাকটেরিয়াগুলির অন্যতম সিউডোমোনাস পুটিডা নিয়ে গবেষণা করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছিলেন। সিউডোমোনাস পুটিডা হল মাটিতে বাসকারী একরকম ব্যাকটেরিয়া, যা মাটির জৈব বস্তুকে ভেঙে সুগার ও অ্যামাইনো অ্যাসিডে পরিণত করে।


তাঁর এই গবেষণাপত্র আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী ডক্টর আরউইন গুনসালাসের নজরে আসলে তিনি ঐ তরুণ গবেষকটিকে চিঠি লিখলেন তাঁর ল্যাবরেটরিতে কাজ করার জন্য। দু’চোখে স্বপ্ন মেখে তরুণ ঐ গবেষক কলকাতা থেকে পৌঁছোলেন ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর এখানেই তিনি আবিষ্কার করলেন ব্যাকটেরিয়াটির একটা বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য। তিনি দেখলেন, কর্পুরকে বিয়োজিত করার জন্য পুরো জৈবরাসায়নিক বিক্রিয়াগুলি যে জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তা ব্যাকটেরিয়াটির আসল DNA তে নেই, রয়েছে প্লাজমিডে (Plasmid)। প্লাজমিড হল ব্যাকটেরিয়ায় উপস্থিত অতিরিক্ত একটি অতি ক্ষুদ্রাকার ও চক্রাকার DNA। সিউডোমোনাস পুটিডা নিয়ে বাঙালি গবেষকটির গবেষণার অগ্রগতি ছিল ওই পর্যন্তই কারণ এর পর পর তিনি জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানির R & D কেন্দ্রে যোগদান করেন। আর ঠিক সেই সময়তেই ঘটেছিল টোরি ক্যানিয়ন বিপর্যয় !


শুনে গবেষক মশাইয়ের মাথায় এলো, যে সব ব্যাকটেরিয়ার তেল ভক্ষণের ক্ষমতা রয়েছে তাদের সেই বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী জিনকে যদি শনাক্ত করা যায় এবং তা প্লাজমিডে আছে কিনা নির্ণয় করা যায় তবে সেই সব জিনের একত্র সমাবেশের চেষ্টা করে নতুন একপ্রকার ব্যাকটেরিয়া উদ্ভব করা যেতে পারে। ভাবনাটা প্রকাশ করতেই জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা দারুণ তারিফ করলেন এবং তাড়াতাড়ি ওই গবেষণা শুরু করতে বললেন। সত্যিই এমনটা তো আগে কেউ ভাবেননি। তরুণ বিজ্ঞানীটি বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার স্ট্রেন থেকে চারটি প্লাজমিড চিহ্নিত করলেন যেখানে তেল ভক্ষণকারী জিন অবস্থিত। ট্রায়াল অ্যান্ড এরর পদ্ধতিতে তিনি প্লাজমিডগুলোর কম্বিনেশন করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন। শেষে দুটি প্লাজমিডকে তাঁর বেশ মনে ধরল। এবার অতিবেগুনি রশ্মি প্রয়োগ করে তিনি দু’প্রকার প্লাজমিড একসাথে জুড়ে দিয়ে সিউডোমোনাস পুটিডা ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে তা প্রবেশ করালেন এবং দেখতে লাগলেন ওই জোড়া প্লাজমিডের তেল ভক্ষণকারী দুটি জিন একসাথে সক্রিয় হয় কিনা।


অবাক কান্ড, দুটি জিনই সক্রিয় হল। দেখা গেল সংযোজিত প্লাজমিড সমন্বিত সিউডোমোনাস পুটিডা তেল ভক্ষণে অনেক বেশি পটু হয়ে উঠেছে। দুটি জিন পৃথক পৃথকভাবে তেল বিয়োজনে যতটা কার্যকর, দেখা গেল সংযোজিত অবস্থায় তারা দ্বিগুণের বেশি কার্যকর। তিনি তো এটাই চাইছিলেন। সময়টা ১৯৭১ সাল। সৃষ্টি হলো ইতিহাস, বিশ্বে এই প্রথম ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা সম্ভব হল জিন এর কেরামতিতে এক নতুন ব্যাকটেরিয়া (Genetically engineered bacteria)। আর সেই সাথে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে গেল সেই তরুণ বাঙালি বিজ্ঞানীর নাম – ডক্টর আনন্দমোহন চক্রবর্তী, বিদেশের মাটিতে 'আল' নামে পরিচিত।


তিনি এই সৃষ্টি করা ব্যাকটেরিয়ার নাম দিলেন “Multiplasmid hydrocarbon degrading Pseudomonas”। সমুদ্রে তেল ছড়িয়ে পড়লে সিউডোমোনাস পুটিডার ওই তৈরি করা স্ট্রেন তেলের দুই তৃতীয়াংশ হাইড্রোকার্বন বিয়োজিত করতে সক্ষম। সারা বিশ্বে আজ তেল শুষে নিতে ব্যাবহার করা হয় তাঁর আবিষ্কৃত এই প্রযুক্তি।


তবে কাহিনীর এখানেই শেষ নয় বরং শুরু। ডক্টর চক্রবর্তী এবার ওই ব্যাকটেরিয়ার পেটেন্টের জন্য আবেদন করলেন। ১৯৭২ সালের ৭ই জুন উনি মার্কিন যুক্তরাষ্টের পেটেন্ট অফিসে আবেদনপত্র জমা দেন। সেটাই ছিল বিশ্বে প্রথম কোনও জিন-পরিবর্তিত জীবের (Genetically Modified Organism বা GMO) পেটেন্টের জন্য আবেদন।

কিছুদিন পর পেটেন্ট অফিস থেকে চিঠি এল – আবেদন খারিজ। কারণ হিসেবে বলা হল, জীবিত কোনও বস্তুর পেটেন্ট দেওয়ার আইন নেই।


কথাটা মিথ্যেও নয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে তো প্রাকৃতিক জীবের কথাই ধরা হয়েছে। যে জীব প্রকৃতিতে নেই, কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে, তার ক্ষেত্রে কেন পেটেন্ট হবে না? তৎকালীন মার্কিন পেটেন্ট ও ট্রেডমার্ক কমিশনার সিডনি ডায়মন্ড পেটেন্ট না-মঞ্জুর করার জেদে অটল রইলেন। বাধ্য হয়ে ড. চক্রবর্তী US Court of Customs and Patent Appeals –এ আবেদন করলেন। রায় এল ডক্টর চক্রবর্তীর পক্ষে।


ঐতিহাসিক এই রায়ে বলা হল, “The fact that microorganisms are alive is without legal significance for purpose of patent law.”। কিন্তু পেটেন্ট কমিশনার এই রায় মানলেন না। তিনি সুপ্রিম কোর্টে মামলা করলেন। এই মামলাও স্থান পেল ইতিহাসের পাতায় “Diamond Vs Chakrabarty” মামলা হিসেবে। আট বছর ধরে চলেছিল সেই মামলা। অবশেষে ১৯৮০ সালের ১৬ই জুন ন’জন বিচারপতির বেঞ্চ ঘোষণা করল আরো এক ঐতিহাসিক রায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির সম্মতির ভিত্তিতে GMO এর ওপর পেটেন্ট দেওয়ার নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত। এই লড়াইয়ে ডক্টর আনন্দমোহন কেবল জয়ী হলেন না, সারা বিশ্বে GMO এর ওপর পেটেন্টের পথ খুলে গেল। আন্তর্জাতিকভাবে বিরাট পরিচিতিলাভ করলেন ড. আনন্দমোহন চক্রবর্তী। বিজ্ঞানীমহলে তাঁর নতুন নামকরণ হল প্রফেসর_সিউডোমোনাস”।


আফশোসের কথা, এই খ্যাতিমান বিজ্ঞানীকে আমরা সেভাবে চিনলামই না। বীরভূম জেলার সাঁইথিয়ায় এক মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে আনন্দমোহনের জন্ম হয় ১৯৩৮ সালের ৪ঠা এপ্রিল। সাঁইথিয়া হাইস্কুল ও বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির থেকে তিনি স্কুলের পাঠ শেষ করে স্নাতক স্তরে পড়ার জন্য কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োকেমিস্ট্রি তে স্নাতকোত্তর ও PhD. করেন। বাঙালিরা খুব বেশি না চিনলেও বিশ্বের বিজ্ঞানী মহলে যুগান্তকারী আবিষ্কার 'জেনেটিক ক্রসলিঙ্কিং'এর জন্য আনন্দমোহন 'আল' চক্রবর্তী এক সমীহ জাগানো নাম।


আধুনিক ক্যান্সার চিকিত্‍সার ক্ষেত্রেও রয়েছে তাঁর অবদান। তাঁর আবিষ্কার থেকে জানা যায় ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে রয়েছে 'আজুরিন' নামে এক বিশেষ প্রোটিন। আর এই প্রোটিন মানবদেহে ক্যান্সার ছড়িয়ে দেওয়া রুখে দিতে পারে। এই আবিষ্কার থেকেই পথ খুলে যায় ক্যান্সার চিকিত্‍সার অন্যতম মাধ্যম কেমোথেরাপি।

২০০৭ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে। ২০২০ সালের ১০ই জুলাই প্রবাসী এই বাঙালি বিজ্ঞানী ঘুমের মধ্যেই চলে গেলেন না ফেরার দেশে...। ‌