PK

Life

 প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার উৎপত্তি


জড়জগতে বিবর্তনের মহাবিশ্বের উৎপত্তি এবং তার বিকাশ। প্রায় সাড়ে চার'শো কোটি বছর আগে পৃথিবীর জন্ম হ'য়েছিলো। মহাবিস্ফোরণ (বিগ-ব্যাং) থেকে শুরু ক'রে প্রথম পর্যায়ের অণুর উৎপত্তি, সময়ের নির্বাহে একসময় শক্তির প্রাধান্য তারপর পদার্থের প্রাধান্য, তারপর তারামণ্ডল, কোয়েসার, ছায়াপথ, সূর্য, নক্ষত্র, সৌরজগৎ, গ্যালাক্সি সবকিছুর পর পৃথিবীর জন্ম। 


সাড়ে চার'শো কোটি বছর আগে পৃথিবী আজকের

পৃথিবীর মতোন ছিলো না। তখন পৃথিবীতে প্রাণ ছিলো না। পৃথিবী ছিলো গরম উত্তপ্ত, আর আকাশ ও পৃথিবী পরিপূর্ণ ছিলো বিষাক্ত গ্যাসে (মিথেন গ্যাস)। একসময় পরিবেশ বদল হলো, পৃথিবীও আস্তে আস্তে সময়ের সাপেক্ষে ঠান্ডা হওয়া শুরু করলো। পরিবেশ অনুকুলে এলে সঠিক তাপমাত্রা, সময় এবং উপাদানে এককোষী জীবের উদ্ভব ঘটলো। ( এটি কোনো পূর্ব পরিকল্পিত কারণ নয় ) 


জীবনের প্রথম আবির্ভাব নিয়ে অনুকল্প বা হাইপোথিসিস আছে। এগুলো কে মোটামুটি #পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যায়।

১/ অতিপ্রাকৃতিক ঘটনাঃ জীবনের আবির্ভাব হ'য়েছে অতিপ্রাকৃতিক ( Supernatural ) ও অজ্ঞেয় ঘটনা হিশেবে।

২/ সৃষ্টিবাদঃ বিশেষ লক্ষ্যে বা উদ্দেশ্যে ( পূর্ব পরিকল্পনা ), পরিকল্পনার অংশ হিশেবে জীবনের সৃষ্টি করা হ'য়েছিলো। এর নাম সৃষ্টিবাদ বা বিশেষ সৃষ্টিতত্ত্ব ( Theory of special creation )।

৩/ স্বতঃজননবাদঃ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ময়লা আবর্জনা থেকে প্রাণের সৃষ্টি হ'য়েছে। এ ধারণা কে বলা হয় স্বতঃ জনন তত্ত্ব ( Theory of spontaneous generation )।

৪/ বর্হিজগতে উৎপত্তিঃ এ-ধারণা অনুযায়ী জীবন পৃথিবীর বহিস্থ ( Extra terrestrial ) পরিবেশ থেকে। ধারণা করা হয় পৃথিবীর বর্হিজগতে কোথাও না কোথাও প্রাণ আগে থেকে ছিলো, আর সেখান থেকে পৃথিবীতে এসে প্রাণের বিকাশ ঘটেছে।

৫/ জৈব রাসায়নিক তত্ত্বঃ রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মধ্য আদিম পরিবেশে অজৈব (জড়) বস্তু হ'তে পৃথিবীতেই জীবনের উৎপত্তি হ'য়েছে। এই তত্ত্বের নাম জীবনের রাসায়নিক উৎপত্তি তত্ত্ব ( Chemical theory of origin of life ) বা অজীবজনি ( Abiogenesis )। 


প্রথম দু'টি অনুকল্প বিজ্ঞানভিত্তিক নয়। এই তত্ত্ব দু'টি আসলে ম'নে ক'রে বিশাল পরিকল্পনার অংশ হিশেবে সুপ্রিম ন্যাচারাল কেউ পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টি ক'রেন। ত'বে তত্ত্বগুলোর কোনো অবরোহ বা অনুসিদ্ধান্ত নেই, কিংবা থাকলেও তা' পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ দ্বারা যাচাই করা যায় না।


প্রাচীন ভারত, চৈনিক সভ্যতা কিংবা ইজিপশিয়ানরা বিশ্বাস করতো – "নিম্ন" শ্রেণির প্রাণী যেমন কীটপতঙ্গ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাটি, কাদা, ময়লা আবর্জনা থেকে জন্ম নেয়। আবর্জনা কাদার মধ্যে কীটের ডিম পাড়ে ফলে কীটের জন্ম হয়, তা' জানতে হ'লে যে শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ যন্ত্রের প্রয়োজন, তা' সেই প্রাচীন সভ্যতাতেই ছিলো না।


এরকম অনেক মজার বিষয় বৈজ্ঞানিক মহলেও আছে। দু'টি কথা বলা যাক। ব্রিটিশ সায়েন্টিস্ট আলেকজান্ডার নিডহ্যাম ( ১১৫৭–১২১৭ ) শুধুমাত্র বিশ্বাস করতেন ফার গাছ সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে ফেলে রাখলে সেখানে রাজহাঁস জন্ম নেয়।

আবার, সায়েন্টিস্ট জ্যান ব্যাপিটিস্ট হেলমেন্ট ( ১৫৮০–১৬৪৪ ) ভাবতেন ঘর্মাক্ত নোংরা ব্রা ঘরের কোনায় রাখলে সেখানে ইঁদূর জন্ম নেয়। 


জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত উৎপত্তির ধারণা প্রাচীন। গ্রীক দার্শনিক এ্যারিষ্টটলের জানা ছিলো যে- জীব থেকে জীবের উৎপত্তি, তবুও এ্যারিষ্টটল কিছু ছোট প্রাণীর ( যেমন কিছু মাছ, পতঙ্গ ) স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্ভব হয় ব'লে বিশ্বাস করতেন। তাঁর বিখ্যাত বই "প্রাণী জগতের ইতিহাস" ( Historia Animalium ) - এ একটি বিবরণ দিয়েছেনঃ

"অধিকাংশ মাছের জন্ম ডিম থেকে হ'য়ে থাকে। ত'বে এমন কিছু মাছ আছে যেগুলোর জন্ম হয় কাদা ও বালি থেকে। একবার নিডোসের কাছে একটি পুকুর শুকিয়ে যায়। এর তলদেশের কাদাও শুকিয়ে যায়। তারপর বেশ কয়েকদিন পর বৃষ্টিতে পুকুরটি ভরে যায়। এরপর দেখা গেলো পুকুরে জন্মেছে নানা রকমের 'মূলেট জাতীয়' ছোট মাছ। কাজেই এটি পরিষ্কার যে কিছু মাছ স্বতঃস্ফূর্তভাবে জন্মায়। তার জন্য ডিমের বা যৌনক্রিয়ার দরকার হয় না।" 


জীবনের প্রথম আবির্ভাব হ'য়েছিলো মহাবিশ্বে। সেখান থেকে পৃথিবীতে জীবন এসেছে। এ অনুকল্পের নাম বহির্বিশ্বে জীবনের উৎপত্তি ( Extra terrestrial origin of life )। প্রথম দিকে রিখটার, আরহেনিয়াস এবং পরে ব্রুকস, শ', ক্রিক, হোয়েল, বিক্রম সিংহ প্রভৃতি এই তত্ত্বের প্রচারক ছিলেন। তাদের ম'তে পৃথিবীর বাইরে কোনো গ্রহে বা অন্য কোথাও জীবনের উৎপত্তি হ'য়েছে। সেখান হ'তে প্রাণ স্পোর বা অণুবীজ হিশেবে পৃথিবীতে এসেছে। 


কার্ল স্যাগান এবং শকোভস্কি ১৯৬৬ সালে অণুজীবের আন্তঃনাক্ষত্রিক পরিভ্রমণের মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা দেখিয়েছেন।


পৃথিবীতে প্রায়ই উল্কাপিণ্ড আছড়ে পরে। এগুলোকে প্রাথমিকভাবে প্রাণকণার বাহন ব'লে ম'নে করেন বহির্বিশ্বে জীবনের উৎপত্তি তত্ত্বের প্রবক্তারা। কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্যবেক্ষণ ক'রে দেখা যায় সমস্ত এ্যামাইনো এসিড উল্কাপিণ্ডের উপর ভর ক'রে পৃথিবীতে এসেছে সেগুলোর সাথে পৃথিবীতে তৈরি এ্যামাইনো এসিডের পার্থক্য অনেক। মহাকাশের উল্কাপিণ্ডের সাথে আসা এ্যামাইনো এসিডগুলোর মধ্যে কিছু বামাবর্তী এবং কিছু ডানাবর্তী ( left and right-handed ) ; ফলে এগুলোর কোনো আলোক ক্রিয়া নেই। কিন্তু পৃথিবীতে প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি এ্যামাইনো এসিড গুলো সব বামাবর্তী ( left-handed )। এ-ছাড়া কিছু এ্যামাইনো এসিড উল্কাপিণ্ডে পাওয়া যায় যেগুলো পৃথিবীর কোনো জীবে নেই। তা'ই অধিকাংশ বিজ্ঞানী ম'নে করেন এসব এ্যামাইনো এসিড থেকে পৃথিবীর এ্যামাইনো এসিড তৈরি হ'বে না।

আসলে এ-পৃথিবীতে অজৈব পদার্থ হ'তে জীবনের উৎপত্তি হ'য়েছে। এবং তা' কোনো সু-পরিকল্পিত কারণে নয়, বরঞ্চ জানা কিছু রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে– জীবনের এই রাসায়নিক উৎপত্তি তত্ত্বকেই ( Chemical theory of origin of life )। পৃথিবীর অধিকাংশ বিজ্ঞানীরা সঠিক ব'লে মানেন।